আমার রক্তে জেগে উঠে শত সহস্রাধিক তথা বহু বছরের জলতরঙ্গের শিহরিত জলছবি থেকে আজকের যুগের সভ্যতাখচিত পদচারণা। এক আদিম অর্ধউলঙ্গ সভ্যতা নিরোধক মানব তিরধনুক হাতে তুলে ছুটে চলেছে পাহাড়ের পথরেখাকে হার মানিয়ে। মৃগ, শূকর কি গো শিকার যার উদ্দেশ্য। কখনো আবার পাথরের হাতিয়ার হাতে হিংস্রতায় উদ্গত অরণ্যচারী জন্তুর সাথে চলছে জীবন-মৃত্যুর লড়াই। পক্ষান্তরে, দৈহিক কামনা-বাসনা যেখানে শুধু এক অনুভূতিহীন আদিম অভ্যাসমাত্র। পশু কিংবা লোমশ মানুষের ভিতর যার কোনো প্রভেদ নেই। কতটাইনা বোকার স্বর্গে বাস করেছিলেম। আবাস্থলের দীর্ঘ কাষ্ঠদণ্ডে জড়ানো নিজের সন্তানের হস্তযুগল পরস্পর হতে বিচ্ছিন্ন করেছিলেম প্রকাণ্ড লৌহদণ্ডের প্রচণ্ড আঘাতে। অতঃপর তুঙ্গাভদ্রা নদী তীরের আদিম গুহামানবটির পদচারণা সিন্ধু নদীর পাড়ে।
লিটলম্যাগ বিন্দু bindu.bangmoy.com
বজ্রপাতের অতিমহারথী সেই অতিপ্রাকৃতিক দানবীয় বিজেতার শক্তি আর দাম্ভিকতার নিকট পরাজিত হয়ে তার প্রতি আমরা বশ্যতা স্বীকার করেছিলেম। যা থেকে নিতান্তই উদ্ধারের উপায়ন্তর না পেয়ে তার প্রতি আমরা হয়েছিলেম সমর্পিত। এমনি করে উদ্ধারের উপায়ান্তর না পেয়ে, নেহাত নিজের অপারগতায় সমর্পিত হয়েছিলেম বস্তুগত বজ্রপাত থেকে শুরু করে প্রাণসচল সাপ, বাঘ, সিংহ আরো কতোসব ভয়ঙ্কর প্রাণীর নিকট। তবে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জীব হয়ে শুধু যে নিজের অপারগতার কাছে নতি স্বীকার করবো এমন হীনবল-অপকৃষ্ট আমি বা আমরা নই। বৃক্ষের অমোঘ নিরতিশয় ত্যাগ স্বীকারে তার প্রতি যেমনি হয়েছিলেম সমর্পিত তেমনি প্রাণস্পন্দনক্ষম উপকারীসব জীবসত্তার প্রতি। এই অতিপ্রাকৃতিক-দানবীয়, অতিতুষ্টকর-পরহিতব্রতী প্রাথয্য থেকেই কোনো এক অতিমানবীয় প্রাথয্যের কল্পনা। অর্থাৎ অতিসমর্পণ আর অতিকৃতজ্ঞতাবোধ থেকেই বিশ্বাস জন্মাতে শুরু করে এক অদৃশ্য সত্তার প্রতি। যার নাম দিলেম সৃষ্টিকর্তা অর্থাৎ ঈশ্বর। চোখে দেখিনি—অদৃশ্য, আপন স্পর্শে অনুভূতি জাগেনি—কায়িক অনুভূতিহীন, শুধুমাত্র বিশ্বাস যেখানে দিল এক অধরা—না ছোঁয়া অতিআবেগীয় অনুভূতির জন্ম। বিভিন্ন গুনের মহিমায় অলংকারিত বিভিন্ন নামে আমাদের কানে পৌঁছাতে থাকে বিভিন্ন কর্মগুণে মহৎ দেবদেবী আর কর্মদোষে পাপিষ্ঠ অসুর কিংবা রাক্ষসগণের নাম। জানা গেলো এ মহাজগতের সৃষ্টির দেবতা ব্রহ্মা, প্রতিপালনের দেবতা বিষ্ণু এবং ধ্বংসের দেবতা শিব। এখানেই শেষনা। প্রকৃতিশান্তিতে আস্থাপরায়ণতায় আরো এলো গগনের দেবতা, বায়ুর দেবতা, বৃষ্টির দেবতা, মৃত্তিকার দেবতা, সমুদ্রের দেবতাসহ নাম জানা-অজানা কতোসব দেবতাগণের। বিজ্ঞ, প্রজ্ঞাবান, প্রথিতযশা, সর্বজ্ঞখ্যাত দার্শনিকগণ তাদের গুণগান লিপিবদ্ধ করলেন তাম্রলিপি কিংবা প্রস্তরখণ্ডে। রংতুলির স্পর্শে যা একসময় হয়ে উঠলো আরো জীবন্ত। পক্ষান্তরে, মানুষের অনুভুতিহীন যৌনতায় এলো সুখময় অনুভূতির সাড়া। শুনেছি ঐ লাল পাহাড়ের মানুষেরা নাকি দেব-দেবীর যোনি পূজা করে। কি অদ্ভূত—বিশ্রী ওদের আচার! আবার রাজন্যবর্গের চিত্তরঞ্জনে শিল্পীর শৈল্পিক প্রতিভার জাগরণ ঘটে কোনো এক সুঠাম—সুন্দরী উলঙ্গ নারীর সমস্ত দেহাংশে আপন দৃষ্টি নিক্ষেপণে, অতঃপর সেই উলঙ্গ প্রতিমূর্তি স্থান পায় রাজপ্রাসাদে-মহাঅট্টালিকায়। পক্ষান্তরে, ধর্মবলে নারী হয় দেবদাসী। কখনোবা সমাজের অধিকর্তা পুরোহিতগণের অশুভ যৌনাবৃত্তি যেখানে পেয়ে যায় কামক্রীড়ার চিরায়ত স্বীকৃতি।
লিটলম্যাগ বিন্দু bindu.bangmoy.com
ধর্মীয় সিঁড়ির চৌহদ্দিপ্রাচীরের বন্দিদশায় আবদ্ধ হলেম ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র নামক জাতখন্ডে। নৈতিক আচরনভেদ মূখ্য নয়—গাত্রবর্ণ ও পেশার ভিত্তিতে সমাজের অধিকর্তারা দ্বিখণ্ডিত করলেন আমাদের। যেখানে শুধুমাত্র ব্রাহ্মণদের পুরোহিতকর্মে তুষ্ট হতে পারেন দেবতাগণ—যারা দিবেন ধর্মীয় নেতৃত্ব, ক্ষত্রিয়গণ হবেন বীরযোদ্ধা—রাজ্য রক্ষা তথা ভূ-রাজনৈতিক নেতৃত্বই যাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য, বৈশ্যগণ ঘটাবেন ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসার, আর শূদ্রগণ হলেন কৃষিকাজ ও গার্হস্থ্য পেশায় নিয়োজিত শ্রমজীবী মানুষ যারা ব্রাহ্মণসহ সকলের সেবাদান করবেন। ভাগ্যের বিড়ম্বনা আমাকে শূদ্র খন্ডের অগ্নিময়গণ্ডিতে নিক্ষিপ্ত করলো। যেখানে আমার হাতের অন্নভোজন অন্য জাতখন্ডের জন্য নিষিদ্ধ, আমার হাতের রান্না পায়েসান্ন যেথায় অভিশাপতুল্য, কালো বর্ণের পোশাক যেথায় আমার জন্য নির্ধারিত, আপন বর্ণ-পরিচয়সূত্র যেথায় আমার প্রিয়তমার সহিত আমার বৈবাহিকবন্ধন নিষিদ্ধযোগ্য, তুচ্ছ তাচ্ছিল্য—হাসি তামাশা তথা সম্মানহানি করতে আমাকে ডাকা হতো মুচি, মেথর, পোদ, চাড়াল প্রভৃতি নামে। একসময় অব্দি সেই শব্দগুলোকে আপনকর্মের সাথে মিলমিশ না ঘটিয়ে তারা ক্ষান্ত হলো না। আমি চিৎকার করেছিলেম, সেদিন পাগলের মতো প্রলাপ বকেছিলেম! আর কতো—আর কতো! মুক্তি দাও—মুক্তি দাও! এখানেই শেষ হলে তাও ভালো ছিল। ধর্মের মনগড়া প্রাচীর মানুষের বিবেককে ধ্বংস করে সেথায় বিষফোঁড়ার জন্ম দিলো। একদিন সময় এলো আমার বৃদ্ধ পিতার পরলোকগমনের। প্রাণটা নিরুদ্দেশ হলো, আর দেহটা পড়ে রইলো এই মর্তধামে। এখন যে দেহটার শুদ্ধি প্রয়োজন। তা শুদ্ধি ঘটবে কেমনে? সন্তানের হাতের অগ্নিময় মশাল ছাড়া এ শুদ্ধিযে ঘটেনা। কিন্তু বড় দুর্বল চিত্ত আমার। যে পিতার জন্য পৃথিবীর আলো বাতাসের স্পর্শ পেলাম, নিজে অভুক্ত থেকে যে আমাকে খাওয়াতো তার শরীর আমার হাতের আগুনের জ্বলন্তশিখায় জ্বালাবো কেমনে? আমার ডানপাশ থেকেই উচ্চারিত হলো একটা মায়াভরা অচেনা বাক্য। বাবা, এ যে ধর্ম—আগুন দাও মুখে! মনকে বুঝালাম, চিত্তকে স্থির করলাম সে সংস্কার মেনে নিতে। কিন্তু এর পরের দৃশ্য আমার হৃদপিণ্ডকে সম্পূর্ণরূপে ক্ষতবিক্ষত করলো, চিত্তকে কোনোভাবেই আর স্থির রাখা গেল না। একজন পিতার পঁচত্বপ্রাপ্তিতে তারই জিয়ন্ত দয়িতাকে নিক্ষেপ করা হলো জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডে। সেই অগ্নিগর্ভ থেকে বের হতে থাকে তীক্ষ্ম আর্তনাদ। বাঁচাও! বাঁচাও! আমাকে রক্ষা করো! আমি পারিনি তাকে রক্ষা করতে। আমাকে যে হস্তরুদ্ধ করে রাখা হয়েছিলো অতিকায় আসুরিক সংস্কারপন্থিদের বাহুবন্ধনে।
লিটলম্যাগ বিন্দু bindu.bangmoy.com
কই কেউ কি আছেন আমাকে রক্ষা করবে এ দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে—মুখপোড়া এই কালিময় সংস্কার থেকে রেহাই দিয়ে শোনাবে মুক্তির গান? পরক্ষণে ঠিকই উত্তর মিললো। হাঁ, আছেন। শাক্যমুনি গৌতম বুদ্ধ এসেছেন আমাদেরকে রক্ষা করতে। স্ত্রী, পুত্র, সংসারকে নিঃশব্দে যে বিদায় জানায় মানুষের দুঃখ মুক্তি তথা নির্বাণলাভের আশায়। অশ্বথ গাছের তলায় যার ঘটে নির্বাণলাভ।ধর্মের কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাসকে পদাঘাত করে সে চোখ রেখেছে স্বাধীন চিন্তার ঔজ্জ্বল্যময় নক্ষত্রভরা আকাশে।নিজেকে সে ঈশ্বরের সন্তান বা পয়গম্বর দাবী করেনি।সে কখনো বলেনি এটা ধর্ম, তাই প্রশ্ন করা যাবে না। বিশ্বাসের উপর ভিত্তি নয়, তার কাছে ভিত্তির স্থান হচ্ছে যুক্তি—যুক্তির স্বচ্ছতা ও তার বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ। তবে বুদ্ধ একি তোমার ধর্ম নাকি দর্শন?তাহলে শাক্যমুনি গৌতম বুদ্ধ কি পারবেন আমার দুঃখমুক্তি ঘটাতে—শ্রেণিনিপীড়নের হাত থেকে আমাকে রক্ষা করতে? একদিন তাই কপিলাবস্তুতে তার শিষ্যের নিকট থেকে বুদ্ধের শিষ্যত গ্রহণ করলেম। কিন্তু একি? যে গৌতম বুদ্ধ মানুষের দুঃখ মুক্তির আশায় তপস্যারত হয়েছিল শূণ্য আকাশের নিচেঅশ্বথবৃক্ষতলায়, অনাহার ও কঠোর তপস্যা শেষে যার ঘটেছে নির্বাণলাভ আর কিনা তারই আদর্শে আদর্শিত আচার্যগণ দুঃখমুক্তি নিয়ে তর্ক করেন রাজপ্রাসাদে, সর্বদা আহার করেন ঘৃতপক্ক ব্যাঞ্জন অথচ যারা ফলায় সে খাদ্যশস্য তারাই কিনা থাকে অনাহারে—অর্ধাহারে, দিনশেষে তাদের পর্ণকুঠিরে আহার জোটে শাকান্ন। হীনযান, মহাযান, শূন্যবাদ, সর্বান্তিবাদ, তন্ত্রবাদসহ বিভিন্ন মতবাদে বিভক্ত হল বৌদ্ধবাদ। কিন্তু জীবহত্যা ছাড়া কেমনে জুটবে আমাদের আহার? যখন কিনা আমাদের শ্রমে পুনর্জীবিত ভূমির কর্ষিত দেহের উপর শায়িত অঙ্কুরিত বীজের নবযৌবনের গর্ভপাতে জন্ম হওয়া খাদ্যশস্য, সবুজ ফলজবৃক্ষের ফলাদি সবটাই আচার্যগণের আহারের জন্যে রক্ষিত। ষড়রিপুর আদিষ্টে জাগ্রত কামতৃষ্ণার দমন কি করে সম্ভব? আবার কামত্যাগ করলে কিভাবে ঘটবে সন্তানলাভ—কিভাবে সচল রবে আমাদের আগামী প্রজন্ম?বুদ্ধ তোমাকে জানা সত্যি কঠিন।হে বুদ্ধ, তুমি কি বলেছিলে তোমার মূর্তি বানিয়ে তোমার অনুসারীদের পূজা করতে? কিন্তু পূর্বসূরিদের অনুকরণে এখানেও শুধু বুদ্ধের নয়—পূর্বেকার মতো অন্যসব দেবদেবীর পূজা অর্চনা শুরু হল। মুক্তি মিললো না শ্রেণিবৈষম্যের বদ্ধ প্রাচীর হতে।
লিটলম্যাগ বিন্দু bindu.bangmoy.com
এতোসব যন্ত্রণা সহ্য না করতে পেরে আমারি আপন ভ্রাতা একদিন এদেশ ছেড়ে জাহাজে করে পাড়ি জমালো সুদূর রোম শহরে। সেখানটায় যাবার পর আর কে রেখেছে কার খোঁজ! আমার আগামী প্রজন্ম কি জানবে তাদেরি আপন রক্তধারা বইছে ঐ রোমে? কেমন করে আমার সন্তানগণ চিনবে তাদের ভ্রাতুষ্পুত্র-পুত্রীগণের? শুনেছি ওখানটায় নাকি এক ঈশ্বর পুত্র এসেছেন। নাম যীশু খ্রীস্ট। একদিন সে ইহুদি ধর্মপ্রচারক, সংস্কারবিদ সেই ‘রাব্বি’ অবতীর্ণ হলেন মসিহরূপে খ্রীস্টধর্মের কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্বে। শুনেছি ক্রুশবিদ্ধে ঘটে তার জীবনাবসান। তবে অন্ধতা সেখানেও থেমে নেই। সেখানেও ধর্মীয় যাজকগণ একসময় অত্যাচারী হয়ে উঠলেন। অন্ধবিশ্বাসে ডুবে থাকা তারাই হলেন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার সর্বোচ্চতম ব্যক্তি। হে অন্ধগণ, মনে কি পড়েনা পৃথিবী সূর্যের দ্বন্দে ধর্মদ্রোহিতার অভিযোগে নিজ গৃহে অন্তরীণ অবস্থায় তোমরা কার মৃত্যু ঘটিয়েছো? তবে সত্য-মিথ্যার দ্বন্দে তারা একদিন সত্যকে স্বীকার করতে শিখলো। আর তবেইকি একদিন তারা এগিয়ে থাকবে অন্যের থেকে—সত্যকে স্বীকারের দৃঢ়তায় জাগরিত প্রাণময় শক্তির আলোকোজ্জ্বল মহিমায়?
লিটলম্যাগ বিন্দু bindu.bangmoy.com
শুনেছি আরব দেশে এক অবতার এসেছেন। যার কাছে মানুষের কোনো উঁচু নিচু জাত নেই—সকলেই সমান মানুষ। উনি কি আসবেন আমাদের দেশে এ যন্ত্রণার পীড়া থেকে মুক্তি ঘটাতে? এতো উঁচু নিচুর দীনতা যে সহ্য করা দুরূহ। জানা গেলো আদম নাকি আমাদের আদি পিতা। তবেকি যেই আদম সেই মনু? হাঁ, একদিন দূরের এই পথিক গ্রহণ করলো সুদূর আরব দেশের সেই অবতারের দীক্ষা। কিন্তু মুক্তি কি মিললো? শ্রেণীবৈষম্যের সেই শিকড় হতে কিছুটা মুক্ত হতে পারলেম ঠিকই, কিন্তু মানুষে মানুষে কেনো এতোটাই জাতিবিদ্বেষের বিষ ছড়ানো? আবার কেনো আপন কন্ঠনালীর শিয়া-সুন্নি প্রভেদ? তলোয়ারের ঝনঝনানিতে কেন-ই-বা বাধ্যতামূলক আমন্ত্রণপীড়ন? ধর্মতো মুক্তির সনদ। তার নাম নিয়ে কেনো এক মানুষ অন্য মানুষকে প্রাণনাশের যুক্তি খণ্ডায়? বিধর্মী আর ঈশ্বর অবিশ্বাসীদের ধর্মের মহাপবিত্র মায়াবলে কাছে টানতে ব্যর্থ হলে শেষমেশ তাদের হত্যা চেষ্টা কি মহাপাপ নয়? সেসব কথায় আমারি আপন বিবেকতো সাড়া দেয় না। তবে কি মানুষকে হত্যার পূর্বে তারা বিবেককে হত্যা করিনি? মূর্তিপূজা ও প্রতীকী প্রার্থনা পরষ্পর বিরোধী কেন? ধর্মসূত্রে কেনই বা হবে বিধর্মীকে কোনো নিকৃষ্ট প্রাণীর সাথে তুলনা? বৃথা নয় কি হুর, পরী, গেলমান বাসনা; বিশ্রী—নিকৃষ্ট নয়কি বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, বহুগামিতা, দাসদাসীর সাথে অবাধ যৌনাচার, উলঙ্গ নারী দর্শনে মনতুষ্টতা কিংবা সেইসব ভয়ভীতি বা আতঙ্ক প্রবণতা? নালন্দার গ্রন্থাগারের নব্বই লক্ষাধিক বই পোড়ালো কে? তাহলে কোথায় গিয়ে ঠেকবে এ ভূমির বিজ্ঞান, দর্শন, ইতিহাস, অর্থনীতি, রাজনীতি, গণিত, ন্যায়শাস্ত্র, চিকিৎসা বিজ্ঞান, কাব্য ও সাহিত্য? এই ধর্ম নামেই দিনে দিনে নির্মোচন হতে চললো আমারি দেবীসুলভ মায়ের মস্তক্রোধ্বের টিক্লি, কপালের টিপ, নয়নের কাজল, কর্ণের দুল, স্কন্ধের হার, হাতের চুরি, পায়ের নূপুর আর শেষমেশ কিনা তার আপন কণ্ঠের লালিত গান। অথচ এটাইতো আমাদের পরিচয়—শত সহস্র বছরের পরিচয়। জাপানিরা যেখানে আজ তাদের সহস্রাধিক বছরের পুরানো ঐতিহ্যকে আলিঙ্গন করে চলেছে আর সেখানে আমরা কিনা আমাদের শত বছরের পুরানো ঐতিহ্যকে পরিত্যাগ করতে চলেছি শুধুমাত্র ধর্মের শিকল পায়ে বেঁধে; দামী বা ব্যয়বহুলসোনা, হীরা, মুক্তাতে শোষণেররক্তাভ উৎপীড়ন চিহ্ন লেগে থাকে—দর্শনের মহামূল্যবান সে আপত্তি থাকলে তাকে অবশ্যই স্বাগত জানানো যেতো; কিন্তু তেমনটিতো আদৌ নয়। তবে এটাইকি আমাদের বিবেকের পরাজয় নয়? একটি জাতির অঙ্গসজ্জা, তার কন্ঠের লালিত গান থেকে কি তার ধর্মীয় পরিচয় বড় হতে পারে কখনো? যদি হয় তাহলে সে জাতির ধ্বংস অনিবার্য নয় কি? আমার অতীত ও বর্তমান সবটাই যেন এক কলসি দুধের ভেতর ফোঁটা ফোঁটা বিষ। কখনোবা সেটা শুধুই সংস্কারে আবার কখনোবা গ্রন্থ’লিপিতে আবদ্ধ। যা পান করলে মস্তিষ্কের মৃত্যু অনিবার্য। তাই বিষটার বিক্ষেপণ ব্যতীত যা পানের পুরোটাই অযোগ্য। অতঃপর আমি যুক্তি খণ্ডায়, বিশ্লেষণ করি। মানুষ হত্যা করা কিছুতেই যে ধর্ম হতে পারেনা। যুদ্ধে কিংবা বিপ্লবে যার তাৎপর্য ভিন্ন। মূর্তিপূজা ও প্রতীকী প্রার্থনা একে অপরের সম্পূরক। নীতিবোধকে জীবনের আদর্শ ছাড়া ব্যক্তির ধর্মীয় ও সামাজিক পরিচয় পুরোটাই অর্থহীন।
লিটলম্যাগ বিন্দু bindu.bangmoy.com
যখন একদল মানুষ তাদের বিশ্বাসের মৃতস্তূপ নিয়ে অস্থিরতায় ফেটে পড়ে তখন আমারি এক প্রতিমূর্তিআমারি সম্মুখে প্রতীয়মান হয়ে উচ্চারিত করে, ‘হে মানব, আপন জাতিধর্মকে পুঁজি করে তোমরা বেহুশ পথ চলিছো। যেকথা তোমার বিবেক—আত্মা পরিত্যাজ্য করিছে তা ধর্ম নয়। মনে রেখো ধর্মকথা তোমরা মানুষেরাই করেছো পাণ্ডুলিপিবদ্ধ। যেথা আছে লোপ, ঘৃনা, ভয়; মনে রেখো সেকথা ধর্ম নয়। মানুষের বিবেক সর্বাপেক্ষা উত্তম ধর্মগ্রন্থ। কারণ মানুষকে ঠকানো, আঘাত বা অশ্রদ্ধা এমন সকল অন্যায়কাজে আমাদের বিবেক আমাদের মধ্যে অপরাধবোধ জাগিয়ে তোলে। প্রকৃতিগতভাবেই আমাদের রয়েছে এই অসীম ক্ষমতা।’
লিটলম্যাগ বিন্দু bindu.bangmoy.com
অতঃপর আমি সকলকে ডাকলেম। গোল হয়ে একত্রে বসতে বললেম সকলকে। কোনো জাতিধর্মের সত্যতা ও মানবিকপরায়ণতাকে অস্বীকার করে নয়, বরং সকল অসত্য ও দৈন্যতাকে পরিত্যাজ্য করে—কোনো জাতিধর্মকে অসম্মান করে নয়, বরং আমাদের বিবেককে সম্মান করেই আমাদের এই নবযাত্রার সূচনায় আমরা হলেম সম্মুখস্থ। অতঃপর সকলে এক হয়ে উচ্চারিত করলেম, ‘মানুষে মানুষে ভালবাসায় ধর্ম, দুঃখী মানুষের দুঃখ লাঘবই ধর্ম, বঞ্চিত মানুষের প্রাপ্যতা আদায়ের পূর্ণতায় ধর্ম, অনাহারীকে আহারের তৃপ্তিদানই ধর্ম, আপন এক সঙ্গিনীতে তুষ্ট যৌনাবৃত্তি ধর্ম, জাতিধর্মের অসত্য ও দৈন্যতার অবমূল্যায়ন ধর্ম, দেশকে ভালবাসায় ধর্ম, সুন্দর—সুখী—সমৃদ্ধ পৃথিবীর দীপ্ত বাসনায় ধর্ম। মন্দির, মসজিদ, গির্জা, প্যাগোডা সবটাই সমান। যারা একটিকে বিশ্বাস করে, তারা অন্যটিকেও বিশ্বাস করবে। লোক ঠকানো, মানুষকে আঘাত বা অশ্রদ্ধা, অশালীনতা, আত্মপ্রবঞ্চনা, বিশৃঙ্খলা, অন্যায়ভাবে অর্থ বা সম্পদ গ্রহণ, হীনমন্যতা, পরশ্রীকাতরতা এসকল অন্যায় হতে মুক্তি তথা সকলকিছুতেই নিজ বিবেককে সম্মান জানানোই ধর্ম। এটাই আমাদের ধর্ম—মানবধর্ম।’
মন্তব্য