কোরাকাগজের খেরোখাতা
থমথমে গহিরায় কিন্তু বেশিদিন স্বস্তিতে থাকা গেলো না। পাক হানাদার বাহিনী আর রাজাকারদের দৌরাত্ম্য বাড়তে শুরু করেছে। আমাদের বাড়ি থেকে আরও কিছুদূর গেলে গহিরা স্কুলের পাশ দিয়ে যে রাস্তা গিয়েছে সেখানে আছে কুখ্যাত চৌধুরী বাড়ি। পাকিস্তান গণপরিষদের একদা স্পিকার মুসলিম লীগ নেতা মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানীদের দোসর ফজলুল কাদের (ফকা) চৌধুরীর বাড়ি। তার কুখ্যাত পুত্র যুদ্ধাপরাধী সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরী, মিলিটারিদের জীপ গাড়িতে চড়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখিয়ে দিতে লাগলো অমুসলিমদের ঘর, মুক্তির ঘর, মানে যে ঘরের কেউ মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিতে গিয়েছে, এমনকি যারা তার দলের নয় তাদের ঘরবাড়িও। আর তারপরে চলতো গুলি, হত্যা, ধর্ষণ....আমি অবশ্য এসব তেমন বুঝতাম না, পরে শুনেছি।
লিটলম্যাগ বিন্দু bindu.bangmoy.com
আমার বড় ফুপা পটিয়া আওয়ামী লীগের নেতা ছিলেন। তিনিও গহিরাতে এসে আশ্রয় নিয়েছিলেন। আবছা ছায়ার মতো চোখে ভাসে কিছু দৃশ্য, কিছু স্মৃতি আমাকে খোঁচায়—একদিন যেন ঘুটঘুটে অন্ধকার ঘরে মাটির মেঝে খুঁড়ে একটি বড় গাদা বন্দুক, পাখিশিকারের কিনা জানি না, পুঁতে রাখা হয়। এ সময়ের চিত্র নিয়ে আমার একটি কবিতা আছে। এটা এখানে বসিয়ে দিলে বলার কাজটা হয়তো কমে আসে কিছু—
লিটলম্যাগ বিন্দু bindu.bangmoy.com
না, কিছুই মনে তো নেই।
সেই যে ন’মাস গোলাগুলি-পলায়ন-লোটাকম্বল সাথে নিয়ে;
অথবা হুদাই দৌড়ের ঘোরে পগার পার - ছুটে যাওয়া দিকভ্রান্ত...
লিটলম্যাগ বিন্দু bindu.bangmoy.com
মনে নেই, কোথাও বন্দুক-রাইফেলের ফুঁসে ওঠা,
কোথাও আমার কোনো মা কিংবা দিদি, খালা, ফুফু —
এমনকি ফুটফুটে কিশোরীর চিবুক-বুক-জঙ্ঘা চিরে চিরে
দেখে নিয়েছিল ‘ভেতরে সবার সমান রাঙা’।
লিটলম্যাগ বিন্দু bindu.bangmoy.com
কোথাও বিচ্ছুরা টেঁসে দিলো—
উড়িয়ে গুঁড়িয়ে শেষ করেছিলো সেনাদের কুচকাওয়াজ।
কোথাও ফজর হলে আতঙ্কের তসবী দানা
কেঁপে কেঁপে বলেছিল ‘ইন্নালিল্লা’ ‘ইন্নালিল্লা’।
কোথাও ঘেও কুকুরের মরা আর্তনাদ!
এসবের সাথে - আমার মেলেনি দেখা।
লিটলম্যাগ বিন্দু bindu.bangmoy.com
আমি শুধু চোখে শর্ষে ফুল দেখেছি ন’মাস।
আমাকে কোলের ‘পরে সযত্ন আড়ালে নিয়ে
অবিশ্রাম ছুটে চলা জনকের;
মায়েদের দ্রুতলয় শ্বাস, হাঁপাতে হাঁপাতে ছোটা…
শহরের পেছন পাড় দিয়ে কখনো ফতেয়াবাদ;
ফতেয়াবাদের কাছে ট্যাঙ্ক পৌঁছে গেলে দ্রুত
দূরের মাদার্শা গ্রাম;
কোনো একদিন আবার গহিরা পূর্বপুরুষের ভিটা…
লিটলম্যাগ বিন্দু bindu.bangmoy.com
শুধু মনে আছে— দিনেও ভীষণ অন্ধকার ছিলো।
জাহেলিয়া যুগে চারপাশ ঘুটঘুটে—
সকলে ফিসফিস করে কথা বলে।
আমাদের সুতীব্র ক্রন্দনগুলো
মুখচাপা দেয় বাবা কর্কশ অথচ দয়ার্দ্র হাতে।
আমাদের আম আঁটির ভেঁপুগুলো
কে যেন ছুঁড়েই ফেলে দিয়েছে কোথাও।
বেতপাতার বাঁশীও লাপাত্তা।
লিটলম্যাগ বিন্দু bindu.bangmoy.com
শুধু চোখে ভাসে মাটির মেঝেটি খুঁড়ে
পাখি শিকারের বন্দুকটিকে কবর দিচ্ছে ফুফা।
আর বেড়ার ফোঁকর থেকে
বাইরে ট্যাঙ্কের ধীর আগমন বার্তা
বলে যাচ্ছে চাচা ফিসফিস স্বরে।
লিটলম্যাগ বিন্দু bindu.bangmoy.com
আদিগন্ত নীরবতা ভেদ করে শুধু,
কোথাও মায়েরা যন্ত্রণায় কাতরে ওঠে,
কখনো ঠুস ঠুস করে মুক্তির গুলিতে
কেবল পাখিরা আনন্দের হল্লা জুড়ে উড়ে যায়।
কখনো রাজহাঁস ভাসে…
লিটলম্যাগ বিন্দু bindu.bangmoy.com
না, যশোর রোডের কথা, শরণার্থী ক্যাম্প,
যুদ্ধ-হত্যা-অনাচার কিছুই দেখিনি - কিসসু পড়ে না মনে!
পিতার স্নেহের হাত আগলে গেছে সন্তানের সব ভয়।
আমি তো কেবল পাঁচ - কেন নই পনের পঁচিশ?
(জিললুর রহমান / যুদ্ধদিনের শিশু/রচনা ২০১৭/গ্রন্থ-ডায়োজিনিসের হারিকেন, ২০১৮)
লিটলম্যাগ বিন্দু bindu.bangmoy.com
এখানে এই কবিতাটির প্রসঙ্গে একটু বলে নিই। মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা তো নেই, এমনকি আজ স্মৃতি ও শ্রুতির মধ্যে পার্থক্য করাও দায়। আর কোনো একটা বিষয় মাথায় রেখে কবিতা লেখাও আমার হয় না। তাই দেখা গেলো, এই কবিতা লেখার আগে পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে আমার কোনো কবিতা লেখা হয়ে ওঠেনি। ২০১৭-এর ডিসেম্বরের শুরুতে আমার অত্যন্ত প্রিয় কবি আসাদ মান্নান আমাকে একটি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে কবিতা পাঠাতে বলেন। সেদিন সেসময়ে তাঁকে কোনো প্রতিশ্রুতি দিতে পারিনি। তারপর নিজের ভেতরে এক মর্মান্তিক মনোযন্ত্রণা চলতে থাকে। আমি কেমন কবি, যে নিজ জাতির সবচেয়ে গৌরবের অধ্যায় নিয়ে একটি কবিতাও লিখিনি?! আত্মধিক্কারে জর্জরিত হতে হতে ভাবতে লাগলাম, কী আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা মুক্তিযুদ্ধকালের? তখন ধীরে ধীরে স্মৃতি ও শ্রুতির মেমরি একাকার করে যে শব্দগুলো আঙুল দিয়ে নেমে এলো সেই ডিসেম্বর ২০১৭ সালের এক গভীর রাতে, তা-ই টুকে রেখেছিলাম। কবিতাটি তার ক’দিন পরেই চট্টগ্রাম শিল্পকলা একাডেমির হলে বিজয় দিবস উপলক্ষে কবিতা পাঠের অনুষ্ঠানে পাঠ করেছিলাম। মনে আছে, তরুণ কবি পার্থ অগাস্টিন সেদিন অনুষ্ঠান শেষে এই কবিতা নিয়ে অনেক উচ্ছলতা প্রকাশ করেছিলো। পরে কবিতাটি কবি আসাদ মান্নানও খুব পছন্দ করেছিলেন। যাক্, ফিরে যাই স্মৃতিকথায়।
লিটলম্যাগ বিন্দু bindu.bangmoy.com
সাকা চৌধুরী, রাজাকার আর মিলিটারির দৌরাত্মে একসময় গহিরাতে থাকা আর নিরাপদ মনে হলো না। আব্বার তো আর যাবার কোনো জায়গা জানা নেই, তাই তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন বাঁচি আর মরি শহরে নিজ বাসায় গিয়েই থাকবেন। অতএব, শহরে যাবার জন্যে খোঁজখবর ও প্রস্তুতি শুরু হলো। খবর নেওয়া হলো, ছোট ছোট বাচ্চাকাচ্চা আর মহিলা নিয়ে এতদূর যাবার উপায় কী? একদিন জানা গেল, কিছু কিছু বেবিট্যাক্সি চলাচল করছে। যাওয়া যাবে। তবে হানাদারদের অত্যাচার চলমান। বিশেষত কাউকে অমুসলিম মনে হলেই তারা ছাড়তো না। ধরে নিয়ে যেতো।
লিটলম্যাগ বিন্দু bindu.bangmoy.com
লিটলম্যাগ বিন্দু bindu.bangmoy.com
আব্বা তাই বুদ্ধি করে গ্রামের সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ একজন ব্যক্তি, যার চুল দাঁড়ি সব সফেদ সাদা, মাথায় টুপি তো আছেই, তাঁকে বেবিট্যাক্সিতে সামনে ড্রাইভারের পাশে বসিয়ে দিলেন। ট্যাক্সি চলার সময় তাঁর দাঁড়িগুলো পাটের আঁশের মতো উড়েছিলো নিশ্চয়। আব্বা নিজে মাথায় টুপি দিলেন, আম্মার তো বোরখা আছেই। আর এদিকে আমরা দুজন শিশু মাত্র। শঙ্কাকুল যাত্রা শুরু হলো।
লিটলম্যাগ বিন্দু bindu.bangmoy.com
তবে, হালদা নদী পেরুতেই সাত্তার ঘাটে মিলিটারি চেক পোস্টে আমাদের বেবিট্যাক্সি থামিয়ে দেখলো। আম্মার দোয়াদরুদ পাঠ কিংবা পক্ককেশ শশ্রুমণ্ডিত বৃদ্ধ— যে কারণেই হোক, নির্বিঘ্নে ছাড়া পাওয়া গেল। এইভাবে, আরও ২/৩টি চেকপোস্ট পার হয়ে অবশেষে আমরা পৌঁছে গেলাম আমাদের চন্দনপুরা’র বাসায়। শহরে অনেক হত্যাযজ্ঞ হলেও আমাদের বাসা যে-কোনো ভাবে বেঁচে গিয়েছিল। আমাদের গলিটিও দৃশ্যত নিরাপদ ছিল। পরে শুনেছি আমাদের গলির পশ্চিমে ফজলুল কাদের চৌধুরীর পাহাড়ের উপরের বাড়ি থেকে নেমে আসা চিকন নালাটি দিয়ে প্রায়শই রক্ত গড়িয়ে নামতো। তবে, আমাদের মসজিদের ইমাম হুজুর মোখতার আহমেদ, যিনি পরে আমাকে ধর্মীয় আদব কানুন শিখিয়েছিলেন, তাঁর ধারণা ছিল ফকা চৌধুরীর জন্যেই এলাকায় পাকসেনারা অত্যাচার করেনি। আমার একথা মানতে কষ্ট হয় খুব, তবে এমন কতো কথাই তো পঁচাত্তর পরবর্তীকালে পাকিস্তানপন্থীরা ছড়াতে চেয়েছে।
লিটলম্যাগ বিন্দু bindu.bangmoy.com
এর মধ্যে একদিন মেজ মামা ফিরে এলেন। কলিকাতায় মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে ট্রেনিং চলাকালে হঠাৎ দেখতে পান আমার খালাত ভাই শওকত ভাইজানকে। তিনি জ্বরে ভীষণ কাৎরাচ্ছিলেন। নিজের ভাগ্নের এই দশা দেখে তাঁকে কাঁধে পিঠে নিয়ে নানান ঝঞ্ঝাট পেরিয়ে শওকত ভাইজানকে তাদের গ্রাম মোহরায় পৌঁছে দিয়ে চলে এসেছেন আমাদের বাসায়। সবাইকে বলে দিলেন তাঁর এই আগমন গোপন রাখতে, তিনি ক’দিন পরেই আবার চলে যাবেন যুদ্ধের কাজে। তখন রোজার মাস, একদিন সেহেরির সময় হঠাৎ মেজমামা হার্ট অ্যাটাকে মারা গেলেন। চলে গেলেন বটে, তবে তাঁর আর যুদ্ধে যাওয়া হলো না। মেজমামা বেঁচে নেই, কিন্তু শওকত ভাইজান এখনও আছেন। এখনও আমার খালাবাড়ি আগলে রেখেছেন। মোহরার রাজাখান চৌধুরী বাড়ির সেই ঘরটিতে আমার অনেক স্মৃতি আছে। সময় সুযোগ মতো হয়তো কিছু কিছু মনে চলে আসবে।
লিটলম্যাগ বিন্দু bindu.bangmoy.com
যাই হোক। অবশেষে দেশ মুক্ত হয়েছিল ১৬ ডিসেম্বর, বিজয় ঘোষিত হয়েছে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের। চারদিকে আনন্দোল্লাস আর বিজয় মিছিল। তার সাথে সাথে শুরু মুক্তিযোদ্ধাদের ফিরে আসার পালা। সেই বিজয়ের আনন্দ উল্লাস নিশ্চয় ছুঁয়ে গিয়েছিল আমার মা-বাবাকেও। কিন্তু সেসব বুঝে ওঠার মতো বুদ্ধির বিকাশ আমার তখনও তেমন করে ঘটেনি। তবে বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত পতাকা হাতে নেচে বেড়াতাম, এই স্মৃতি ঝাপসা ঝাপসা ভাসে চোখের ভেতরে।
রাত ১১:৩০
০৭ মে ২০২০
অবশ্যই পড়তে ভালো লাগছে
উত্তরমুছুনখুব ভালো হচ্ছে। স্মৃতি আর শ্রুতি মিলিয়ে অনবদ্য।
উত্তরমুছুনক্রমশ উজ্জ্বল হচ্ছে স্মৃতির মুক্তা মালা, বাড়াচ্ছে অপেক্ষার জ্বালা।
উত্তরমুছুনআমি মিলন কিবরিয়া নামে মন্তব্য করতে পারলাম না। অপ্সহন পেলাম না।
মুছুন