আত্মগত কবিপাঠ
পঠিত হলেন কবি নাভিল মানদার
যিনি এক পুষ্পিত মান্দার
সেই খারাপ কথাটা শুরুতে বলাই ভাল। কারণ সে একা- একটিই মাত্র খারাপ- সমস্ত ভালর ভেতরে কোথায়-বা তার ঠাঁই হবে! অথচ তারও, সেই মন্দেরও তো মন আছে- সেও তো চায় তার কথা কিছু হোক! তাই বলি : আচ্ছা নাভিল, কেনো লেখেন কোরে ধোরে হোয়ে বোসে বোলে হোলে এভাবে? এমন লিখনে কী ঘটে? একথা ঠিক যে উৎস বিচারে বানান জিনিসটা ভাষার মতো নয়, প্রাকৃতিক নয়, তা বানানোই; তবু ভাবতে হয়, আমাদের কতটুকুই-বা শুদ্ধ প্রাকৃতিক! -এমনকি যা-কিছু প্রাকৃতিক তাদেরকেও কেটে-ছেঁটে ঘষে-মেজে নিজেদের ব্যবহারোপযোগী বানিয়ে নেয়াটাই আমাদের, মানে মানুষের, জীবন, যেমন কি-না আমরা জীবনকে অবলম্বন ক’রে ভাষাকে বিচিত্র ব্যবহার ক’রে সাহিত্য নামক কিছু-একটা বানাই; ফলে যা হয়, বানানো জিনিসটাও সুদীর্ঘ প্রচলনের ইতিহাসের মধ্যে দিয়ে এক ধরনের স্বাভাবিকতা বা প্রাকৃতিকতা অর্জন ক’রে নেয়- যেটাকে, বিশেষ কারণ ছাড়া, খুব বিশেষত্ব ছাড়া, ভাঙলে একটা অপ্রয়োজনীয় বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়ে। আপনার কবিতার যা স্বভাব, যে অনন্য স্বাভাবিকতায় সে কাছে টেনে নিয়ে মিশিয়ে নেয় পাঠককে নিজের সাথে, সেখানে হঠাৎ হঠাৎ একটি-দুটি বানানের অনৈতিহ্যিক চেহারা কোনো বিশেষ ব্যঞ্জনা সৃষ্টির বিপরীতে বরং নিবিড় মিলনোচ্ছ্বাসের মাঝে দুষ্টের উপস্থিতির মতো।
লিটলম্যাগ বিন্দু bindu.bangmoy.com
কিন্তু লাজ-শরমের কথা এই যে নাভিল মানদারের কবিতা আমার তেমন ক’রে পড়া হয় নি এতকাল- হ্যাঁ, তাঁর বই বেরিয়েছে, হাতে পেয়েছি, পড়েছি, তবু যেন তেমন ক’রে পড়া হয় নি এখনের মতো। তবে আবার সঙ্কোচেরও কিছু নেই এতে আমার কারণ সমস্ত কবিতার আধার যে নাভিল মানদার, স্বয়ং সেই কবির সাথেই এমন আমার চলাফেরা শোয়া-বসা যে যেন তাঁর কবিতার আস্বাদন আমার নিরন্তর আপনিই ঘটে চলে। কিন্তু যখন মনে হল তাঁর কবিতার কথা কিছু লিখি- আসলে তাঁর কবিতার কথা নয়, তাঁর কবিতা ঘিরে নিজেরই কথা, তখন ইচ্ছে ও প্রয়োজন হল তাঁর প্রকাশিত সমস্তের একটা পাঠ হোক- পুনঃপাঠ। এবং বোঝা হল, কখনো কখনো পুনঃপাঠই প্রথম পাঠ- প্রকৃত পাঠ!
দেখুন, ‘সাইকেলের আমোদ’ কবিতার প্রথম স্তবক:
দেহভর্তি পথ নিয়ে ছুটেছে দুরন্ত সাইকেল
উঁচু-নিচু, সমতল কিম্বা সমুদ্রের পর-
তার চাকার ভেতর আছে অঢেল স্মৃতির বায়ু;
শ্যাম পৃথিবীর সামান্যটুকু হাওয়া খেয়ে
কী দারুণ চাঙ্গা আর কর্মী হোয়ে ওঠে চাকার শরীর
দেখো মিলিত যাপন, জোড়া চাকার কেবলি প্রদক্ষিণ
সেইসব চাকা ও চাকার গোলাকার গোল বায়ু
ফুরিয়ে ফুরিয়ে প্রকাশিত- দীঘল পথেই
লিটলম্যাগ বিন্দু bindu.bangmoy.com
দেখা যাক আরও তিনটি কবিতার প্রথম স্তবক:
প্রচুর ঘুমের পর জেগেছে চোখের পাতা আম মুকুলের
পুরনো ফাগুন বন্ধু এসে কেননা ছুঁয়েছে কাণ্ডত্বক,
বহু নিদ্রার জড়তা ভেঙে তারপর আমের মুকুল
তড়িৎ গুছিয়ে নেয় ট্রাভেল ব্যাগের আয়োজন।
ফাগুন বন্ধুর দু’হাত ছাপিয়ে মুকুল যাত্রার শুরু
পেয়েছো কী তুমি আশীর্বাদ ঘনঘোর কুয়াশার
(কবিতা : প্রচুর ঘুমের পর)
মিঠু, সেই সমস্ত অপরিণত মৃত্যু দাঁত মাজে, নাস্তা করে
আর ব্রিজটি পেরিয়ে পোঁ পোঁ হেঁটে বেড়ায় তোমার স্বপ্নে
পরিত্যক্ত পাগলটা কী দারুণ! পাগলের পা কেননা জেনুইন।
তার মধুর হাসিটা ঠিক শাদা ওড়নার ব্যাকুল সুতোর মতো।
(কবিতা : পাগলের হাসি)
খালের সেতুটি দেখেছি সুদূর পথে- দেখেছি সুদূর;
একপাল পাতিহাঁস শামুকের খোঁজে একাকার
ছোট সেতু; সেতুটির তলা দিয়ে ঢুকে গেলো
ভীষণ খালের ডান জল থেকে বাম জলে
তবু মাঝরাতে একইরকম দাঁড়িয়ে সেতুটি আছে
একইরকম শান্ততায় শুয়ে আছে জল- সনাতন জল
(কবিতা : নৈশভোজ)
লিটলম্যাগ বিন্দু bindu.bangmoy.com
এখন কথা হচ্ছে, কেউ যদি আমাদেরকে ব’লে না দেন, আমরা কি সত্যিই কি খুব বুঝতে পারছি কোন্ কবিতাটি নাভিল মানদারের তৃতীয় কাব্যগ্রন্থের আর কোনটি-বা দ্বিতীয়, প্রথম, চতুর্থ? কিন্তু একথা ঠিক, সামান্য খেয়াল করলেই দেখতে পাচ্ছি বাকভঙ্গিটির ভেতরে অভিন্নতা আছেই- এক অন্তর্লীন সাযুজ্য। এটাই আমার বিশ্বাস: একজন কবি জীবনভর যত যা-ই করুন না কেনো তাঁর একটি আত্মকেন্দ্রিক বাকভঙ্গি থাকেই এবং তা তাঁর প্রথম পর্বের রচনাবলীর মধ্যেই গড়ে ওঠে- ক্রমশ হয়ত সেটাই আরও স্থির, পরিস্ফুট হতে থাকে- আর এটাই সেই সুপরিচিত তত্ত্বেবর জন্মস্থান: জীবনব্যাপী একজন কবি একটিই কবিতা লিখে চলেন! নাভিল মানদার কবি হিশেবে বিশিষ্ট যে, তার প্রমাণ প্রথম কাব্যগ্রন্থ থেকেই একটি বিশেষ বাকরীতির তিনি অধিকারী- যেন, অর্জিত নয়, এ তাঁর সহজাত!
লিটলম্যাগ বিন্দু bindu.bangmoy.com
চারটি কাব্যগ্রন্থ তাঁর প্রকাশিত: ভূ-বারান্দা (২০১৭), নুনের আঘ্রাণ (২০১৫), বাদামি পুকুর (২০১০), আলোকাটা লেন (২০০৮)। হ্যাঁ, সহজাত একটা সহজিয়া ভাব ও হাবভাব ও ভাষাস্বভাব তাঁর আছে- যেন নেই চিরাচরিত দার্শনিকতার দায়; যেন ভাষ্য যদি-বা কিছু আছে, ভাষ্যের ভার কোনো নেই; যেন তাঁর পঙক্তিসকল উড়ে উড়েও নয়, হাওয়ায় কেবলি ভেসে ভেসে আসে :
একহাড়ি শাদা ভাত তারা প্রত্যেকেই অপলক শাদা
ভাতে ভাতে দেখা হয়, কথা হয়, কতো না আলাপ হয়
পৃথিবীর তাবৎ ভাতের শরীরে কীভাবে ঢুকে যায় দূর শাদা রঙ
গতকাল গাছতলায় তোমার একটি শৈশব দ্যাখা গেছে।
চাকা গড়িয়ে চলেছে অবিরাম গোলাকার বোধ নিয়ে
চিকোন গলিতে আজ সন্ধ্যার আঁধার ঢুকে যেতে
কোনো সমস্যা হয়নি।
ফুটফুটে মা-কে চিরবিদায় জানিয়ে
আমি থেকে গেছি এই বড়ো পৃথিবীতে
বিহঙ্গদের বাড়িতে চলো- চলো বিহঙ্গদের বাড়িতে
সেখানে মনের সুখে মাছ ধরার স্মৃতিরা আছে
মাটির গভীরে পোঁতা আছে সূর্যরস
প্রাচীনতম বটগাছটি পার হোয়ে চূড়ামনকাটি গ্রাম।
এই গ্রামের সকল গাছের তলায় ছায়া আছে।
বিধুর পথের পাশে আছে একমাত্র তমাল গাছটি।
রয়েছে কোমল মনের অধিকারিনী বৃষ্টিকা বিশ্বাস
লিটলম্যাগ বিন্দু bindu.bangmoy.com
আসলে এভাবে কীই-বা বলা যায়! আসলে আমি বলতে চাইছি না কিছু, বরং বলবার ছলে নাভিল মানদারের চারটি বই সামনে খুলে রেখে দেখে নিচ্ছি এপাতা-ওপাতা! দেখছি যে কী ভীষণ কী অসম্ভব অজীবনানন্দীয়! পটভূমি রূপে সর্বক্ষণ প্রকৃতি রয়েছে অথচ একবারও জীবনানন্দ মনে পড়বে না- কতটা কঠিন ভাবা যায়! অথচ এই কঠিন সাবলীল সহজ নাভিলের কবিতায়। কবিতা কি ক্রমশ সহজ হতে চায়? নির্ভার? না, জীবনানন্দ বরং ক্রমশ অধিকতর মননশীল- মননের আলো খুব ভারী। বিনয় ক্রমশ হয়ে ওঠেন নির্ভার আর নির্ভার; এমনকি উৎপলকুমারকেও দেখি সহজ নির্ভার হয়ে উঠতে, তাঁর ‘সুখ-দুঃখের সাথী’ প্রমাণ। কিন্তু নাভিলের সহজতা উৎপলকে মনে পড়ায় না, কোথাও কোথাও পাঠকের মনে বিনয়ের একটু হাওয়া লাগতে গিয়েও লাগে না- নাভিল থেকে যান একান্ত নাভিল হয়েই।
লিটলম্যাগ বিন্দু bindu.bangmoy.com
একটা কথা মনে হয়: নাভিলের পদে পদে, এবং বাস্তবিকই তাঁর পায়ে পায়ে, কল্পনা! তা আমি তাঁর সাথে চলতে-ফিরতে এত দেখি যে এখন কিছু-একটা দেখলে আমি চট ক’রে বুঝে ফেলতে পারি সেই দৃশ্যটি নাভিলের কল্পনায় কেমন হতে পারে। একদিনের কথা বলি: আমরা হেঁটে হেঁটে রাজাপুরের দিকে যাচ্ছি- হঠাৎ দেখা গেল একটা বাড়ির উঠোনে মাচায় অনেক কুমড়ো ঝুলে আছে; ফল সুপক্ব হয়েছে ব’লে পাতা সব শুকনো, মিয়োনো, কেবল কুমড়ো আর কুমড়ো দৃশ্যমান এবং কুমড়োগুলোর জাত এমন যে গা খুব ঝকঝকে মসৃণ- দেখামাত্রই নাভিল স্বাভাবিক ব’লে ওঠেন: আরে, মাচায় দেখি মাজা বাসনকোসন ঝুলে আছে! আমি তাকিয়ে দেখি, সত্যিই তো, ছাই দিয়ে মাজা ঝকমকে কাঁসার বাসন মাচায় ঝুলে আছে! আর এই তো সেদিন- যশোর শহরে তাঁর সাথে যে খোলা রিক্সায় চড়েছি তা ব্যাটারি-চালিত ব’লে নিঃশব্দে চলে এবং খুব তা অল্প উচ্চতার- নাভিল চ’ড়ে ব’সেই একটু পর বলেন: মনে হচ্ছে আমরা কেবল বসে রয়েছি আর রাস্তাটা চ’লে চ’লে আমাদেরকে নিয়ে যাচ্ছে...। নাভিলের কল্পনাকে তাই ইমাজিনেশন বলা যায় না বা কল্পনাপ্রতিভা নামক গম্ভীর শব্দও তাঁর বেলা খাটবে না। কল্পলোক কথাটা বললে যেমন কল্পনা বুঝায় তাঁর কল্পনা তাই, যেটাকে বুঝাতে চিত্রকর-ভাস্কর-সাহিত্যিক মোজাই জীবন সফরী ‘ফ্যান্টাসি’ কথাটা প্রয়োগ করেন- যেন রূপকথার কল্পনা যাতে আচ্ছন্ন হতে হয় যেমন হয় শিশুসকলে- আহা নাভিল মানদার আমাদেরকে শিশু ক’রে তুলতে জানেন! আমরা সব সত্যই দেখি:
ডুমুর গাছের দেহটারে এমন জাপটে ধোরেছে জোছনা
এই বুঝি চন্দ্রহাতে ডুমুরের শ্বাসরোধ হয় হয়...
প্রতিদিন একটি মৌমাছি উড়ে উড়ে
বাকী খেয়ে যাচ্ছে স্তনের ভরাট স্নেহ
বিহঙ্গ ক্রমশ বড় হচ্ছে- দিন আর প্রতিদিন
হস্তরেখা দারুণ আগের চেয়ে অনেক উজ্জ্বল
সীমান্ত পেরিয়ে সে প্রায়ই যাচ্ছে ভিনদেশ,
হয়তো সেথায় আছে দূরগামী নিখোঁজ বন্ধুরা
মাঝে মাঝে বাড়ি ফিরে বিহঙ্গ মায়ের দুধ খেতো
আর স্মৃতি থেকে শিখে নিতো মাছ ধরার কায়দা...
শূন্য বোতলের ভেতর নৈশপ্রহরী তন্নতন্ন হাতড়ে চলেছে
গতকাল হারানো মদের সব সোনালী মুহূর্তগুলো...
নিভৃত শীতের ভেতর অনাথ ঠাণ্ডা
তোমার বস্ত্রের আড়ালে কাঁদছে অবিরাম
ফুটে আছে প্রতিটি পাতার দেহে
অনেকদিনের পুরনো আমার জামা
সন্ধ্যামালতীর নীরব একটি ফুল
হাত দিয়ে চেটে খায় ঝিঁঝিঁপোকা ডাক
লিটলম্যাগ বিন্দু bindu.bangmoy.com
এমন আমরা দেখতেই থাকি দেখতেই থাকি তাঁর ছত্রে ছত্রে শব্দে শব্দে তাহলে কি শুরুতে বানান-ফানান সম্পর্কে যা বলছিলাম সেকথা তুলে নেব? ভাবা যেতে কি পারে না ওটাও কবি নাভিল মানদারের নিজস্ব রূপকথালোকের বানান?!
আর কী বলি? মনে পড়ছে সেদিন রাতের কথা- ওঁর বই চারটে তাক থেকে নামিয়ে বিছানায় একান্ত করি। এটার ওটার পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে একসময় লিখতেই হয়:
গভীরতম এই শীতের রাতে কোনো কান্না যদি চোখ অব্দি এসে বুক খালি ক’রে হালকা ক’রে দেয় তাতে দুঃখ নেই, কিন্তু যে-কান্না বুকের মধ্যে ঘনিয়ে উঠে গলায় এসে কণ্ঠরোধ করে, সে কেমন!!
লিটলম্যাগ বিন্দু bindu.bangmoy.com
কবি নাভিল মানদার ২০১৫ খ্রীষ্টসনে প্রকাশিত ‘নুনের আঘ্রাণ’ নামিত তাঁর তৃতীয় কাব্যগ্রন্থে যে ভুমিকাটুকুন লেখেন তা প’ড়ে ওই দ্বিতীয় কান্না আমি পাই, আর প্রার্থনার মতো বলি: “যেন কবিতা লেখা ছাড়া কোনোদিন তিনি কিছুই করতে না পারেন!...”
বরং সেই ভূমিকাটি এখানে লিখেই দিই- লিখতে লিখতে আরও অনুভব করতে চেষ্টা করি তাঁর অনুভব:
এটা কী কোরে সম্ভব মা আর বেঁচে নেই। প্রতিদিন বাড়ি ফিরে মা ভাত দাও বোলে হাঁক দিতাম। তার দেহপুস্পের বিরল স্নেহ আমাদের আগলে রাখতো শ্যামল সংসারে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই হঠাৎ মারণ-অসুখ তাকে টেনে নিলো। বছর তিনেক বিছানার সাথে লড়ে মা জিতিয়ে দিলো এই পৃথিবীকে। টানা আট মাস ভাত খেতে পারেনি। গলা দিয়ে নামতো না। না খেয়ে খেয়ে দেহটা শুকিয়ে ঠিক যেন পক্ষীছানা তবু তার ফুটফুটে মুখ-জুড়ে নিঃসৃত হতো আলোধানের হাসি। পাকান পিঠের নিভৃত উচ্ছ্বাস। মা আমাকে প্রায়ই বলতো- ওরে আমার লক্ষীসোনা কিছু একটা কর, শুধু কবিতা লিখে তোর চলবে কী কোরে!? আমি শুধু পালাতাম। কবিতা লেখা ছাড়া এখনও অব্দি আমি কিছুই কোরতে পারিনি মা। আমাকে তুমি মাফ কোরে দিও মা। মাগো, মা আমার।
আমার ভেতর বোসে আছো তুমি এক পক্ষীছানা
হ্যাঁ, এখনও তিনি কিছুই আর করতে পারেন নি- যেন কোনোদিন না পারেন কবিতা লেখা ছাড়া কিছুই আর করতে!
শুনেছি আছে কেউ কেউ বলতে : বেশ লাগে- সবখানে প্রকৃতির উপস্থিতি, তার স্পর্শ, তার সাথে নিবিড় সংযোগ এবং পরিচিত ভাব, পরিচিত বস্তু, পরিচিত দৃশ্য সবকে নিরন্তর অভাবিত উপমায়-রূপকে বদলে রহস্যময় ক’রে তোলা- বেশ লাগে, বেশ লাগে পড়তে... কিন্তু তাঁর কবিতায় সময়ের প্রখর দাগ কই? বাঃ, বেশ বললে হে! কিন্তু বলি কি, মানে কী কথাটার? সময়ের প্রখর দাগ জিনিসটা ঠিক কী? মানে, কবিতা পেলেই তার বুক খুবলে দেখতেই হবে ওর মধ্যে আছে কি না কিছু হাউখাউ, কিছু জিন্দাবাদ, কিছু দাঁত-খিঁচানি? এগুলো থাকলে কবিতার দোষ হয় না, কিন্তু সব কবিই কি দিব্যি দিয়েছেন এসব থাকবেই তাঁদের কবিতায়? আরে, সময় যদি বিষধরই হয় তবে তার ছোবল তোমার চেয়ে কিছু কম পড়ে না কবির হৃদয়ে, কিন্তু কবি বলেই তাঁর হাতে ওই বিষের বাঁশি! তবুও দেখো তো, সময়কে হাড়েমজ্জায় না চিনলে কীভাবে তিনি এটা লেখেন- বরং নিজেই তুমি লেখো না কো ‘সূর্যছুটি’-র মতো একটি কবিতা:
মাটির গভীরে পোঁতা আছে সূর্যরস;আহা, সত্যি বলো তো, আগে কখনো শুনেছ প্রবল রোদের শব্দ, দেখেছ টেবিলের পর অশ্রুর দোয়াত, কখনো এমন আকুতি নিয়ে ভেবেছ ভীষণ কাক্সিক্ষত একটি উলঙ্গ হওয়ার দিন? এমন কত-না পাবে তাঁর পাতায় পাতায়! আর শোনো, সময় মানে তোমার সামান্য দেখাটুকু শুধু তো নয়- সময় বলতে আছেন ‘মধুক্ষরা মহাকাল’ -কবি যে তাঁকেও দেখেন!
মানুষখেকো কলম একবার উঁকি মেরে
দেখে নিলো ভ্রাম্যমাণ পথরেখাগুলো
শোনা যাচ্ছে প্রবল রোদের শব্দ
ফোটে পাখি; রঙবাজ মেঘ
টেবিলের পর অশ্রুর দোয়াত;
.
সাপ্তাহিক ছুটি; অফিস উধাও
আজ তোমার উলঙ্গ হওয়ার দিন
লিটলম্যাগ বিন্দু bindu.bangmoy.com
একটা কথা জানি। কবি তাঁর প্রথম বইটি, যার কপি নিঃশেষিত, পরিমার্জনা নয়, সমগ্র বইটির প্রতিটি কবিতা ধ’রে ধ’রে সম্পূর্ণ পুনর্লিখন করেছেন, যা প্রকাশের অপেক্ষায়। এবং তাঁর ইচ্ছে অন্যগুলিও এমনটা করার। কেনো নাভিল? এভাবে কোথায় পৌঁছতে চান? পারফেকশন? পারফেকশনের তো কোনো দৃশ্যমান চুড়ো নেই! কিছু বছর পর যদি আবার এগুলোকে মনে হয় নতুন ক’রে লেখা দরকার? কিন্তু এসব যদি-যুক্ত যুক্তির কোনো মানে নেই বিশেষত যখন একজন কবির মন এমনটা চায় এবং তিনি ক’রেই তা ফেলেন। তখন শুধু একটাই কামনা থাকে: নাভিল, যদি তখনও এমন মনে হয়, মরণের ওপার থেকে এসে শেষ বইগুলো পুনর্লিখিত ক’রে যাবেন!
লিটলম্যাগ বিন্দু bindu.bangmoy.com
হ্যাঁ, এটা অনস্বীকার্য যে মৌল ভাব ও ভাষারীতি সময়ের সাথে সাথে অধিকতর স্থিরতা ও ঘনতা লাভ করতে পারে। এই যেমন আমাকে যদি বাধ্য হতে হয় তবে বলব নাভিল মানদারের প্রথম দুটি কাব্যগ্রন্থ- ‘আলোকাটা লেন’ ও ‘বাদামি পুকুর’ - আমি হয়ত বেছে বেছে পড়ব; আবার এটা অবশ্য খুব ভুল কথা কারণ কবিতায় কবিতায় প্রসাদগুণের তারতম্য থাকতেই পারে তবু সকল কবিতাতেই কবির বৈশিষ্ট্য বিরাজিত থাকেই, ফলে বেছে বেছে নয়, নির্বিচার পাঠই প্রকৃত কবিপাঠ; কিন্তু তবুও কবিকে সরিয়ে যদি কবিতারাই শুধু সামনে এসে দাঁড়ায়, সেক্ষেত্রে ‘নুনের আঘ্রাণ’ ও ‘ভূ-বারান্দা’ এমন আলোমাধুর্যভরা যে তারা তাদের প্রতিটিকেই পড়িয়ে নেবে বারংবার।
লিটলম্যাগ বিন্দু bindu.bangmoy.com
আর কী কথা? আসলে তো কবিতার পাশে সব কথাই অপকথা। তবে অবসান হোক। কিন্তু কবে আপনারা তাঁর বই পাবেন, কীভাবে পাবেন, কে জানে! এখানে কয়েকটি অন্তত সম্পূর্ণ কবিতা প’ড়ে নিন :
১. ধানক্ষেতের নিবাস (কাব্য : নুনের আঘ্রাণ)
এ সকল ক্ষেতের ভেতর ঘন শূন্যতার ঢেউ-
বিস্তীর্ণ মাঠের বুক চিতিয়ে ধানের সোনালী প্রকাশ;
আবহাওয়ার খবর অজানা আছে তবু মাথাপিছু ধান
ধানের সোনালী দেহে এক অবাস্তব মেঘ ঘুরে- আসে বর্ষা।
দেখো পাখি, উড়ে উড়ে ফিঙেরাজ, ঘুরে ঘুরে ফিঙেরাজ
রাজা আছে তবু রাজকীয় ডানায় দিনমজুর জীবিকায়
বিলক্ষণ আঁখি ঠেরে চুমু খায় ধানের পতঙ্গে;
কী সাধু কী ডাকাতির গল্প আমাদের ঘুম আনে...
.
এ সকল সোনালী ধানের সঘন যৌবনে
তুঙ্গ হাওয়ার পাল, উড়েছে বিচিত্র প্রজাপতি
কী বিশুদ্ধ নীরবতা লেপ্টে আছে ধানের সোনালী গায়;
মনে হয় আমাদের ঘুম ফিরে পেয়েছে বালিশ ও বিছানা।
এ সকল ক্ষেতের সীমানা জুড়ে শুধু ধানের আড়ালে ধান
আলোধান তার সম্ভ্রম পেয়েছে দূর ক্ষেতের নির্জনে
মাঠজুড়ে সোনালী ধানের কাছে পেটকাতর সূর্যদেবতা
হাতজোড় কোরে বোসে আছে- অন্ন প্রার্থনায়
২. নলসাক্ষী (কাব্য : নুনের আঘ্রাণ)
রূপদিয়া গার্লস স্কুলের নলকূপটাই কেবল জীবিত;
এক চাপে পাতালের জল কী দারুণ হাস্যোজ্জ্বল
গলগল ক’রে উঠে এসে সকল কলস নিমিষে ভরিয়ে দেয়,
গ্রীষ্মকালের প্রকাণ্ড দাবদাহে সব বাড়ির নলকূপরা শুকিয়ে নির্বাক;
এতোবার চাপলেও একফোঁটা জলও ওঠে না
শুধু ততোবার গলার কর্কশ-ধ্বনি ছাড়া
.
খরা গ্রীষ্মের মৌসুমে গোটা রূপদিয়ার সকল নারী ও পুরুষ
ছুটে যায় গার্লস স্কুলের চিকোন নলকূপের কাছে;
তাদের হাতের মিলিত স্পর্শের সাক্ষী হোয়ে আছে
নিঃসঙ্গ নলকূপের একমাত্র লোহার হাতল
.
প্রিয় ছাত্রীরা ছুটির ঘন্টা শেষে বইখাতার প্রতিটি পৃষ্ঠা
জীবিত নলকূপের শাদা জলে ভিজিয়ে ভিজিয়ে তারপর বাড়ি ফেরে...
৩. একটি-তুমি (কাব্য : ভূ-বারান্দা)
কোকিলের কালো কণ্ঠ গীতকর্মে কম্পমান;
যদ্দুর জেনেছি এই কোকিলের বাড়ি নেই
শুধু একটি বিকেল আছে
শুধু একটি তোমার মতো মুগ্ধ শ্রোতা আছে
তোমার দেহের আসবাবগুলো আকারে দ্বিগুণ
স্বপ্নাতুর; ফুলে ওঠা টেবিলের স্নেহ;
মঠবাড়ির রাস্তাটা ঠাঠানো রোদের তলে কুঁজো হোয়ে আছে;
তবুও রাস্তাটি বিকেলের দিকে ধাবমান
.
তবুও একটি-তুমি শাড়ি পরিহিতা; প্রিয় টেবিলের সমর্থন নিয়ে
তুমি রাত জেগে লিখে যাচ্ছো কোকিলের কালো ভাষা।
৪. ভিখারি শাদা (কাব্য : ভূ-বারান্দা)
বহুদিন ধোরে এই শিউলি গাছটি জলতৃষ্ণায় খাকন হোয়ে আছে
এতো এতো রোদ আর চৈত্রমাস পাতার উপর দিয়ে হেঁটে গেছে
মৃত্তিকার নিচ দিয়ে দূর-বহুদূর হয়তো পাতাল আছে
একফোঁটা জল জোটেনি গাছের কণ্ঠে- পাতায় পাতায়
.
তবু পথে পড়ে থাকা বনশ্রী তোমার সরল থুতুতে
যতোটুকু তৃষ্ণা মেটে যতোটুকু ফোটে শিউলী;- শুভ্রতা।
৫. পুষ্পিত মান্দার (কাব্য : ভূ-বারান্দা)
এমন প্রমত্ত দুপুরের রোদ ফাঁক ক’রে এসেছিলো শালিকের দল;
এসেছিলো মুখরা চড়ুই তার ছোট ছোট ঠোঁটে সুমধুর বাক্য নিয়ে
কেননা মুচিপাড়ার মাঠ ঘেঁষে বিনত দাঁড়িয়ে আছে প্রিয়দর্শিনী মান্দার
আছে তার ডালে ডালে পাতামিত্র আছে রুপালি কাঁটার বাদ্য
.
কেননা ভীষণ চড়ুই ও শালিকের ডানা উদ্ভিদের
কেননা মুচিপাড়ায় সঙ্গমের শব্দ শোনা যায়।
ভারী এই মিষ্টান্ন দুপুর নেমে এসেছে তোমার গ্রামে
তবু এক রুটি খাবো ব’লে গমের ক্ষেতের পাশে বোসে আছি
হে অচেনা পাকস্থলী রহস্যধারী তুমিও; রে মুচিপাড়ার বউ
অথবা তোমার প্রকাণ্ড বুকের মহাকাশে ফুটে আছে প্রোজ্জ্বল নক্ষত্র স্তন
রাত্রিরূপ মিষ্টি আঁধারেতে তুমি প্রিয় বিছানার দেশে ফিরে এসো
প্রিয় চোখের ভেতর প্রকাণ্ড সূর্যাস্ত নিয়ে বিনত দাঁড়িয়ে আছে পুষ্পিত মান্দার
কবিতা শেষ হলে যে নিস্তব্ধতা জাগে চরাচরব্যাপী তার মধ্যে নিজেকে ডুবিয়ে চুপি চুপি নিঃশব্দে দুটো কথা বলি- এটাই শেষ। সব আকুলি-বিকুলি মনে রয়ে গেল- নাভিল মানদারের কবিতা সম্পর্কে, কবিরূপী নাভিল মানদার মানুষটি সম্পর্কে যা অনুভব করি, কিছুই তার বলা হল না; পারলাম না বলতে- পারা যায় না! শুধু এই যে কতকদিন ধ’রে লিখি-লিখির মধ্যে তাঁর বই চারটি নিয়ে ঘুরলাম পথে-রাস্তায় বাসে-রেলে জীবিকাক্ষেত্রে, এই যে এখন রাত তিনটে অবধি তিনি আমাকে জাগিয়ে রেখে আমার আঙুলকে প্রাণময় প্রেমময় ক’রে রাখলেন- এইভাবে আমাদের ভবিষ্যতের জন্য কিছু স্মৃতি গড়া হল- আর কী! আর কবি তিনি রয়েছেনই শব্দমদে চুর সমস্ত দিন সারা নিশা... এবং লিখে রেখেছেন লিখে চলেছেন সকল কবির ও সমস্ত কবিতার মর্মকথা:
শব্দ মদ। এইখানে করতালি। মুহূর্মুহূ নীরবতা।
সকল শব্দরা জামা খুলে দেখিয়েছে তাদের খালি গা।
বিমুগ্ধ দেখেছি প্রতিটি বিবস্ত্র দেহে আছে সূর্যের সারাংশ।
আছে চেরাগের দৈত্য। ঘষা দিও।
পথে পথে অশ্রুর আঘ্রাণ; মৃত্যুক্রিয়া।
নাম ডাকতেই তোমার কপালে পুষ্পিত আকাশ,
সূর্যের বিশ্রাম। শব্দ করতালি;
কান পেতে শুনে নিও মদের বিবৃতি
এইটা দূর্দান্ত হইছে দূর্দান্ত
উত্তরমুছুন