কোরাকাগজের খেরোখাতা
মিলিটারি আসছে শুনলে আমার বাবার আর কোনোদিকে না কি নজর থাকতো না, বউ মেয়ে কারও কথাই নাকি মাথায় থাকতো না। শুধু আমাকে কোলে নিয়ে টাকার ব্যাগটা বগলদাবা করে ছুটতেন, যেদিকে মানুষ ছুটছে তো ছুটছেই। এই ছোটা প্রায় সময়ই ছিলো অর্থহীন। দেখা যেতো অন্য পাড়াতে ঠুসঠাস ফুটিয়ে দু’-চারজন মানুষ মেরে তারা হয়তো চলে গেছে আরেক পাড়ায়, অথচ এদিকে মানুষ পালিয়ে বেড়াচ্ছে গ্রাম থেকে গ্রামে। সেই ভয়, সে আতঙ্ক আমাকে ছোঁয়নি। বাবার বুকের ভেতর পরম মমতায় আমাকে আগলে রেখেছিলেন এমনভাবে যে, আমার স্মৃতিতে কিছুই ঢুকতে পারেনি। তাই ফের শোনা কথার উপরই নির্ভর করে সেসময়টার বর্ণনা করতে হচ্ছে। নানাবাড়িতে থাকার সময় যখন হাতে টাকাপয়সা নেই, অতিরিক্ত জামাকাপড় নেই, তখন বাবা সিদ্ধান্ত নিলেন যে কোনো উপায়ে শহরে গিয়ে কিছু টাকা পয়সা আর জামাকাপড় নিয়ে আসতে হবে। বাবার সাথে মেজমামা আর ভোতক নানা; বিল পাথাড়ি হাঁটতে হাঁটতে ৮ মাইলের সোজাপথ অনেক বেশি দূর ঘুরে যেতে হবে। পথিমধ্যে মিলিটারী ধরার ভয় আছে বলেই ভেতরের গলি ঘুপচি দিয়ে পদব্রজে তাঁদের এই অভিযান নির্বিঘ্নেই সম্পন্ন হয়। একসময় শহরের বাসায় পৌঁছান। এখানেও থমথমে পরিবেশ। কোনোমতে, কিছু জামাকাপড় গুছিয়ে পরের দিন আবার পদব্রজে ফতেয়াবাদ ফিরেন।
লিটলম্যাগ বিন্দু bindu.bangmoy.com
ফতেয়াবাদ ফিরে দেখেন পুরা গ্রাম শুনশান, সাড়া শব্দ নেই। কয়েকজন বয়স্ক পুরুষ মানুষ গ্রামে রয়ে গিয়েছেন শুধু। জানা গেল, মিলিটারির ডেরা খুব কাছেই হওয়াতে নানাবাড়ির সবাই তটস্থ সন্ত্রস্ত ছিলেন। একসময় নানাবাড়ির সকলের সিদ্ধান্ত হলো, এভাবে প্রতিদিন উদ্ভিন্ন হয়ে দৌড়ে পালিয়ে বেড়ানোর হাত থেকে নিস্তার পেতে হবে সবাইকে। বিশেষ করে মেয়েদের নিরাপত্তার জন্যে, আরও ভেতরের দিকে, নদী পেরিয়ে মাদার্শা গ্রামে চলে যেতে হবে। সেখানে আত্মীয় কুটুম্ব কেউ ছিলেন নিশ্চয়। তবে, একেবারেই নিকটাত্মীয় কি না তা আমার অজানা। সম্পর্কে তাঁরাও আমার নানা সম্পর্কীয় বলেই শুনেছিলাম। যাই হোক, মা প্রায় বলতেন, আমি নিজের হাতে খাওয়া শিখিনি এই চার সোয়া চার বছর কালে। হয়তো বড়ছেলের আহ্লাদ বলে একটা ব্যাপার ছিলো, তবে আমি আর তার কী-ই বা জানি। কিন্তু মাদার্শায় পরগৃহে গাদাগাদি মানুষের ভীড়ে মোটা চালের ভাত যখন ডাল আর লবণ ছিটে দিয়ে খেতে দিতো, তখন মা আমার হয়তো রান্নাবান্না বা পরিবেশনায় ব্যস্ত— আমাকে খাইয়ে দেবার ফুরসত তখন তাঁর নেই। আমি না কি আমার ছোটবোনটিকে অনুকরণ করে করে নিজ হাতে খাওয়া শিখেছিলাম। সেই থেকেই বুঝা গেল যে, আমি শৈশবে বেশ গোবেচারা ধরনেরই ছিলাম, হয়তো বোকাও। আর মেমরিও তেমনিই দুর্বল। আমার জানা নেই মাদার্শা-পর্ব কতোদিন চলেছিল। এর মধ্যে বাবাও পরে অনেক কসরৎ করে জামাকাপড় ও টাকাপয়সা নিয়ে মাদার্শায় এসে পৌঁছেছিলেন। এদিকে মেজমামা কোন্ ফাঁকে কার সাথে যেন মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেবেন বলে কলিকাতা চলে গিয়েছেন।
লিটলম্যাগ বিন্দু bindu.bangmoy.com
মাদার্শা আশ্রয়ের কিছুদিন পরে। বাবা সিদ্ধান্ত নেন মাদার্শা ত্যাগ করে আমাদের গ্রাম গহিরায় ফিরে যেতে হবে। তা হলে ক্যান্টনমেন্ট থেকে আরও দূরে গিয়ে আশ্রয় নেওয়া যাবে; নিজগৃহে থাকার স্বস্তিও থাকবে। তখন আমরা চারজনের সাথে বড়মামা মামীও রওনা দিলেন। অনেকদূর হেঁটে রামবেস্যা নামের কোনো এক ঘাট থেকে নৌকা যোগে সাত্তারঘাটে এসে নামলেন। আসার সময় হালদা নদীতে অনেক লাশ ভেসে থাকতে দেখে ভয়ে কুঁকরে গেল সকলের মুখ। সাত্তার ঘাটে নেমেও বেশ কিছু লাশ নদীপাড়ে পড়ে থাকতে দেখা গিয়েছিল। যাইহোক, ওখান থেকে গ্রামপথ দিয়ে হেঁটে বাবা-মা আমাদের নিয়ে গহিরার বাড়ির দিকে এগুলেন। বড় মামা আর মামী আর কিছু যাত্রীর সাথে মিলে ট্যাক্সি নিয়ে রওনা দিলেন মামীর গ্রাম রাঙ্গুনিয়ার দিকে।
লিটলম্যাগ বিন্দু bindu.bangmoy.com
সেদিনের গহিরার আবছা স্মৃতি আমার যেন মনে আছে। নাকি বারবার শ্রবণ থেকে এখন তা স্মৃতিদৃশ্যে পরিণত হয়েছে কে জানে! মনে পড়ে, আমরা অন্ধকার ঘরের ভেতরে গুটিশুটি মেরে বসে থাকতাম। আমরা জ্যাঠাতো ফুফাতো চাচাতো ভাইবোনেরা তো আছিই, পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ সকলেও আছেন। অবশ্য দাদামশাই ৭০-সালেই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেছেন। আমরা উচ্চস্বরে কথা বলতে পারতাম না। কান্না করলে মুখ চেপে ধরে রাখতো গুরুজনেরা। বন্ধ দরোজার ফাঁক দিয়ে চাচাদের কেউ হয়তো ট্যাঙ্কের গতিপথ লক্ষ্য করে সাবধান করছেন।
লিটলম্যাগ বিন্দু bindu.bangmoy.com
আমাদের গ্রাম ছিল রাউজান থানার পশ্চিম গহিরা, সাত্তার ঘাট থেকে মাইল খানেকের মতো গেলেই শিকদারদের ঘাটা পেরিয়ে হাতের বামে একটি চিকন মেঠোপথ এঁকেবেঁকে চলে গেছে। চারধারে ধানের জমি। একটু দূরে ঘন বৃক্ষে আবৃত কিছু বাড়িঘরের চিহ্ন দেখা যায় এই প্রধান সড়ক থেকেই। বাসযাত্রীদের এই মেঠো রাস্তার মুখেই নামিয়ে দেয়। একটু পড়েই হাতি-কোম্পানিদের বাড়ির রাস্তা অনেক চওড়া। বড় দালানটাও বেশ দৃশ্যমান। আমাদের এই মেঠো পথটি জমির আল চওড়া করে নতুন বানানো হয়েছে বলে ‘নোয়া রাস্তা’ নামে পরিচিতি পেয়েছে। মেঠোপথে সোজা চলে গেলে কালাচান্দের হাট। আর, তার অনেক আগেই এই যে মেইন রোড থেকে দৃশ্যমান বৃক্ষবেষ্টিত বাড়ি—একটু হাঁটতে হাঁটতে কিছুদূর এলেই, বামে চিকন একটি আলপথ দিয়ে যেতে যেতে বামে একটি পুকুর, আর পুকুরের পরে উঠোন পেরিয়ে মাটির তৈরি দেউড়ি ঘর। দেউড়ির পরে ভেতরের উঠোন, তারপরেই পাশাপাশি তিনকক্ষের একতলা পাকাবাড়ি। পাকাকক্ষগুলোর পেছনে লাগানো পুরনো মাটির মূল ঘর। প্রথমে মাটির ঘরটিই ছিলো। বিয়ের আগে আমার আব্বা নিজ খরচে পাকাঘরগুলো গড়িয়েছিলেন। একদম পেছনে একটি বেশ বড় রান্নাঘর ছিলো। সাধারণত বাচ্চারা সব এই পাকের ঘরেই পিড়িতে বসে খায়। বাড়ির চারপাশে নানা ফলফলাদির গাছ। আমাদের এই বাড়িকে আমার দাদার নামে মৌলানা আমিনুর রহমানের বাড়ি বলে ডাকে। শুনেছি আমার দাদার বাবা চারটা বিয়ে করেছিলেন। তাঁর অনেক সন্তানাদির মধ্যে ভিটাবাড়িতে সমস্যা তো ছিলোই। আমার দাদা যখন সরকারী চাকুরি করে কিছু অর্থ জমাতে পেরেছেন, তিনি এই জায়গাটা নিজের বাবার কাছ থেকেই কিনে নিয়েছিলেন। তাই আমাদের বাড়িটা মূল পাড়া থেকে সামান্য তফাতে। আমাদের বাড়ির ডানপাশ দিয়ে চিকন একটি সরু মেঠোপথ। পথের ডানপাশে বেতঝাড় ও একটি সরু গড়খাই। চিকন মেঠোপথটি পেছনের হায়দারের বাপের বাড়ির সামনে দিয়ে একটি বড় পুকুরের ধারে নিয়ে যায়। বিশাল পুকুরটির উঁচুপাড়ের দুইপাশে কবরস্থান। আমার দাদাও এই পুকুর পাড়েই সমাহিত। পাড় ঘেঁষে ঈষৎ চওড়া পথ ধরে বামে এগুলেই ডানে মোড় নিয়ে পাশের লম্বা পাড়টার মাঝখানে একটা ঘাট। আর ঘাটের সামনে দিয়ে চলে যাওয়া পথের বাম পাশে সার বাঁধা ঘরগুলোই আমাদের মূল পাড়া, আমাদের জ্ঞাতিদের নিবাস—পাড়াটি খোনকার পাড়া নামে পরিচিত। পাড়ার শেষ মাথায় একটি ছোট মসজিদ; আর তারই পাশ দিয়ে কুলকুল করে বয়ে যাচ্ছে হালদা নদী, তখন জানতাম না কোথায় যাচ্ছে এতো জল! তবে পরে জেনেছিলাম, ‘হালদা খালের উৎপত্তি স্থল মানিকছড়ি উপজেলার বাটনাতলী ইউনিয়নের পাহাড়ী গ্রাম সালদার পাহাড়ী র্ঝণা থেকে নেমে আসা ছড়া, সালদা থেকে হালদা নামকরণ হয়। ৮১ কিলোমিটার দীর্ঘ নদীটি সালদা থেকে উৎপন্ন হয়ে ফটিকছড়ি, বিবিরহাট, নাজিরহাট, রাউজান, হাটহাজারী হয়ে কালুরঘাটের কাছে কর্ণফুলীতে বিলীন হয়েছে।’ শুনেছি ‘এই নদী পৃথিবীর একমাত্র জোয়ার-ভাটার নদী; এবং এখানে রুই জাতীয় মাছ ডিম ছাড়ে এবং নিষিক্ত ডিম সংগ্রহ করা হয়। হালদার সাথে বাংলাদেশের অন্যান্য নদীর সংযোগ নেই বলেই রুই জাতীয় মাছের “জীনগত মজুদ” সম্পূর্ণ অবিকৃত রয়েছে। হালদা নদী কেবল প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ঐতিহ্য নয়, এটি ইউনেস্কোর শর্ত অনুযায়ী বিশ্ব প্রাকৃতিক ঐতিহ্যের ও যোগ্যতা রাখে।’
লিটলম্যাগ বিন্দু bindu.bangmoy.com
শুনেছি আমাদের পূর্বপুরুষগণ খোন্দকারী পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। আমার মা মাঝে মাঝেই ঠাট্টা করে বলতেন, “তোর পূর্বপুরুষেরা মানুষ মরলে খুশি হতো। একে অপরের সাথে বলাবলি করতো, ওদের বাড়িতে একটা পড়েছে।” তাঁর বক্তব্য অনুসরণ করে জানতে পারি, খোনকার বা খোন্দকার বা কাজী—এই লোকগুলো কোনো মানুষের মৃত্যু হলে লাশ ধোয়ানো, জানাজা পড়ানো, কবরের পাড়ে টানা ৪০ দিন ধরে কোরান খতম (পড়ে শেষ) করা, মিলাদ পড়ানো— মোটামুটি অনেক কাজ পেয়ে যেতো। তাই আমার মা খোঁচা দিয়ে বলতো একটা পড়ে গেলে, মানে কেউ মারা পড়লে, মোটামুটি চল্লিশ দিনের জন্যে কয়েক জনের রুজিরোজগারের একটা ব্যবস্থা হতো। কিন্তু আমার দাদা মাদ্রাসা থেকে আলেম হয়ে সেই পেশা থেকে সরে আয়কর বিভাগে সুপারিনটেনডেন্টের চাকুরি নেন। পরে তিনি তাঁর সন্তানদের বিদ্যালয়ে পাঠিয়ে ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত করার চেষ্টা করেন। আমার জ্যেঠা ডাক্তার হয়েছেন, বাবা একাউন্টিং-এ মাস্টার্স করেছেন। কিন্তু সেজবাবা তেমন পড়েননি বলেই শুনেছি। যেহেতু জন্মের পরে মাতৃহারা হয়েছিলেন, তাই পরে তাঁকে যিনি লালনপালন করতেন, তিনি নাকি দুধের সাথে আফিম মিশিয়ে খাওয়াতেন যাতে বেশি কান্নাকাটি না করেন। বাবাদের ভাইদের মধ্যে চতুর্থজন শারীরিক দিক থেকে বিশাল বপুসম্পন্ন ছিলেন বলেই কিনা জানি না, জ্যেঠাতো ভাইবোনদের সাথে আমিও তাঁকে বড়বাবা ডাকতাম। বড়বাবা শুনেছি অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন। বিএসসি পাশ করেছেন। ছোটবাবা তখনও ছাত্র। বড় দুই ফুফুর বিয়ে হয়ে গিয়েছে। আর ছোট দুইফুফু তো ঘরেই ছিলেন। একাত্তরের এই মুক্তিযুদ্ধকালে সবাই এসে লুকিয়েছে এই বাড়িতে। তবে এ যেন এক নিস্তব্ধ পোড়াবাড়ি, ভয়ে পুকুরের মাছগুলিও যেন লাফাতে ভুলে গেছে; এমনকি বৃক্ষের পত্রপল্লবও নড়াচড়া করতে ভীত সন্তস্ত্র।
৩ মে ২০২০
সন্ধ্যা ৭:৪৫
মন্তব্য