জিললুর রহমান। কবি, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক। জন্ম, নিবাস, কর্ম বাঙলাদেশের চট্টগ্রাম জেলায়। পেশায় চিকিৎসাবিজ্ঞানের শিক্ষক। আশির দশকের শেষদিক থেকে লেখালিখি। লিটল ম্যাগাজিন ‘যদিও উত্তরমেঘ’ এর সম্পাদক, ‘লিরিক’ এর সম্পাদনা পরিষদ সদস্য। উত্তর আধুনিক কাব্যচর্চার অন্যতম পথিকৃৎ। লিরিক, নিসর্গ, একবিংশ, সুরমস, বিন্দু, চারবাক-সহ বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনে লিখে আসছেন দীর্ঘদিন। বিন্দুর পক্ষ থেকে তাকে অনুরোধ করা হলে তিনি স্বানন্দে রাজি হয়েছেন আত্মজীবনী লিখতে, এতে আমরা অত্যন্ত খুশি হয়েছি। এই লেখাটি ধারাবাহিকভাবে বিন্দুতে প্রকাশিত হবে। আজ প্রকাশিত হলো প্রথম পর্ব।
- সম্পাদক
কোরাকাগজের খেরোখাতা
শৈশব দুরন্ত হয় বলে কবি-সাহিত্যিকদের জীবনগাথায় লেখা থাকে। যারা রাজনীতিবিদ হয় তাদের শৈশব তো দুরন্ত হতেই হবে। যেমন শেরে বাংলা এক ঘুষিতে নারকেল ছিলতে পারতেন। কিলিয়ে কাঁঠাল পাকানোর প্রবাদ শুনেছি, কিলিয়ে নারকেল ছিলার এই একটিই উদাহরণ। তবে সেদিক বিবেচনায় রবিঠাকুরের শৈশব চারদেয়ালে বন্দী ছিল। বন্দী থাকলেও বাল্যকাল থেকেই প্রাণসখার সাথে বেড়ে ওঠার মতো সৌভাগ্য ক’জনার হয়। আবার রুটির দোকানে কাজ করে লেটোর দলে গান করে বেড়ো ওঠা কাজী নজরুলের বিচিত্র জীবনের কথা পড়লে বড় লোভ হয়।
লিটলম্যাগ বিন্দু bindu.bangmoy.com
যাই হোক, ধান ভানতে শিবের গীত গাওয়া আমার কর্ম তো নয়ই, ধর্মও নয়। অথচ আমার শৈশব কেন পুরা জীবনটাই যেন সেই অনিন্দ্যসুন্দর গানটির মতো বারবার উচ্চারণ করে “মেরা জীবন কোরা কাগজ, কোরাই রহে গেয়া”। তাই সরাসরি বলেই ফেলি যে, নেহাৎ সাদামাটা ধরনের একটি শৈশবই আমার জন্যে অপেক্ষা করেছিল।
লিটলম্যাগ বিন্দু bindu.bangmoy.com
যখন জন্মেছি, তখন বাংলা উত্তাল, ১৯৬৬ সাল। এই যে জন্মকথা, এসব তো আর স্মৃতি থেকে নয়, বলা চলে, শোনা কথা। শুনেছি মূলত মানুষের কাছেই। বাবা ছিলেন অত্যধিক গম্ভীর এবং অমিশুক। বড় হতেও দেখেছি এক কোণায় থম মেরে বসে থাকতেন— পত্রিকা পড়তেন।
লিটলম্যাগ বিন্দু bindu.bangmoy.com
তাই জীবনযাত্রার প্রথম পর্বের বক্তব্যগুলো কিছু শোনাকথা আর কিছু ছবিকথা থেকে বিধৃত হচ্ছে বলে ধরে নেওয়া যাক। ১৯৬৬ সালের ১৬ নভেম্বর তারিখে আমার জন্ম, মোবাইলের কম্পিউটার অ্যাপস ঘেঁটে দেখা গেল সেদিন ছিলো বুধবার। ঠিক কোন্ লগ্নে জন্মেছিলাম এখন আর মনে নেই। মা অবশ্য বলেছিলেন। আবার জেনে নিতে হবে। তবে এটা জানতে পেরেছি, প্রসব-বেদনা ওঠার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত তাঁকে ভাত রান্না সহ যাবতীয় গেরস্থালী কর্ম সম্পাদন করতে হয়েছে। তারপর যখন সময় হলো, তাঁকে নেওয়া হয়েছিল আন্দরকিল্লার রেড ক্রস মেটারনিটিতে। জানতে পেরেছি ডা. আনজুমান আরার হাতেই ডেলিভারি হয়েছিল আমার জন্ম। পরবর্তীতে তাঁর স্বামী ডা. জমির উদ্দীনকে আমার শিক্ষক হিসেবে পাই।
লিটলম্যাগ বিন্দু bindu.bangmoy.com
১৫ মাস বয়সে মা-বাবার সাথে প্রথম ছবি। |
লিটলম্যাগ বিন্দু bindu.bangmoy.com
মায়ের ভাষ্য মতে, আমার নানা ছিলেন সেকালে এতদঞ্চলের প্রথম অ্যাডভোকেট। কলিকাতা থেকে ডিগ্রী নিয়ে যখন ফিরেছেন তখন চট্টগ্রামের রেল স্টেশন লোকারণ্য হয়ে ওঠে তাঁকে সংবর্ধনা দেবার জন্যে। নানাবাড়ির লোকজনের কাছ থেকে পরে শুনেছি, তিনি খুব দয়ালু উকিল ছিলেন। কেউ মামলা করতে এলে নাকি অপরপক্ষকে ডেকে দুপক্ষে মিলমিশ করে দিতেন। তাতে যা হয়েছে, ঘরে বনেদীপনা থাকলেও বিত্তের জৌলুশ ছিলো না। অবশ্য প্রাচীন জমিদার বংশীয় ঠাট আমি ওই পরিবারে এখনও টের পাই। শুনেছি, আমার নানার দাদা, পাঁচলাইশের নিজ বাড়ি ছেড়ে ফতেয়াবাদে শশুরবাড়িতে উঠে আসেন স্ত্রীর জমিদারী দেখার প্রয়োজনে। অবশ্য বনেদী বংশে যা ঘটে, সাহিত্য সংস্কৃতিতে আগ্রহ — সেটা তৈরি হয়েছিল।
লিটলম্যাগ বিন্দু bindu.bangmoy.com
বয়স তখন দুই। |
লিটলম্যাগ বিন্দু bindu.bangmoy.com
আমার জন্মকালে মায়ের বয়স ছিল ১৮ বছর। আর আমার বাবার সাথে তাঁর বয়সের পার্থক্য ১৪ বছরের। এখন বার্ধক্যে যদিও তাঁদের ভরা প্রেম সকলের অনুভূত, সেদিন তাঁদের ভালবাসা তেমন গভীর ছিল কিনা গবেষণার বিষয়। কারণ, এই একটি ব্যাপারে মায়ের কোনো অভিযোগ শুনিনি। আমার বাবা তখন সদ্য প্রতিষ্ঠিত চট্টগ্রাম সিটি কলেজে অধ্যাপনার চাকরি করেন, সাথে সিটি কলেজের প্রতিষ্ঠাতা আয়কর পরামর্শক বাদশা মিয়া চৌধুরির সহকারীর কাজও। শুনেছি বাদশা মিয়া চৌধুরীর সাথে বন্ধুত্ব ছিল আমার দাদার। তাই এম কম পাশ করেই ওনার সহকারী হিসেবে কাজের সুযোগ মিলে যায়। পরে সিটি কলেজ প্রতিষ্ঠা এবং তাতে শিক্ষকের প্রয়োজন পড়লে উনিই বাবাকে কলেজে চাকরি দেন। শুনেছি এই বাদশা মিয়া চৌধুরী চট্টগ্রামের একজন প্রথিতজশা সমাজসেবক।
লিটলম্যাগ বিন্দু bindu.bangmoy.com
লিটলম্যাগ বিন্দু bindu.bangmoy.com
লিটলম্যাগ বিন্দু bindu.bangmoy.com
এসএসসি পরীক্ষার প্রবেশ পত্র থেকে খুলে নেওয়া ছবি। |
লিটলম্যাগ বিন্দু bindu.bangmoy.com
যাই হোক, অনেক কষ্টে দাদা আমার জ্যেঠাকে ডাক্তারি পড়ান, আর বাবাকে একাউন্টিং-এ এম.কম পাশ করান। এখানে বলে রাখা ভাল, সে যুগে মেট্রিক পাশ করার পরে সায়েন্স, আর্টস, কমার্স এসব নির্ধারণ হতো। আমার জ্যেঠা সায়েন্স নিয়ে পড়ছিলেন, ডাক্তারি পড়াও প্রায় শেষ, তখন আমার বাবা মেট্রিক পাশ করলেন। জ্যেঠাকে আমরা জেআব্বু ডাকতাম। তো, জেআব্বু আমার আব্বাকে ডেকে বললেন, আমি তো সায়েন্স পড়েছি, তুই তবে কমার্স পড়্। যেই কথা সেই কাজ। বড় ভাইয়ের প্রতি আব্বার এই ভক্তি জেআব্বুর শেষদিন পর্যন্ত অটুট দেখেছি। আমার মায়ের সাথে বিয়ের সময় অন্যচাচারা তখনও ছাত্র। যেমনটি আমার মা বলেন, তাদের পড়ার সুবিধার জন্যে বিয়ের কয়েক মাসের মধ্যেই দাদার নির্দেশে বাবা শহরে বাসা ভাড়া নেন। বাসাটি সিটি কলেজ থেকে খুব কাছেই—তামাকুমণ্ডি লেইন।
লিটলম্যাগ বিন্দু bindu.bangmoy.com
বেশিদিন সম্ভবত নানাবাড়িতে নবজাতকের প্রারম্ভিক জীবন চালানো যায়নি। ফিরতে হয়েছে শহরে। বাবার চাকরি আছে, চাচাদের পড়ালেখার অসুবিধা ইত্যাকার নানান কারণে। এর মধ্যে আরেকটি তথ্য বেশ ভাল করে আমার মেমরিতে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, আমার জন্মের কারণে বাবা আমার চার্টার্ড একাউন্টেনসি পড়তে যেতে পারেননি—সিদ্ধান্ত পাল্টাত হয়েছিল। শহরে জন্ম, সিটি কলেজ আর নিউ মার্কেটের কাছেই বেড়ে উঠেছি, কিন্তু স্বাধীকার আন্দোলনের উত্তাপ বুঝে ওঠার মতো বয়সটা অর্জন করতে পারিনি। না হলে, এখানে সেই উত্তাল সময়ের একটা ফাটাফাটি বর্ণনা লিখে ফেলতে পারতাম। এরমধ্যে কোনো একসময় '৬৯ চলে আসে। গণ অভ্যুত্থানের দিন। ৬ দফা আন্দোলন চলছে। আমার বাবা খুব ভীতু মানুষ শুধু উদগ্রীব হয়ে রেডিওতে বিবিসি শোনেন। আর সন্ত্রস্ত হতে থাকেন, আবার এক ধরনের উচ্ছ্বাসও। সিটি কলেজের ছাত্ররাই তো চট্টগ্রামের সকল আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলো। বাবার অবশ্য কাজের ব্যস্ততাও ছিলো অনেক। সকালে পলিটেকনিক কলেজে ক্লাস, তারপর সিটি কলেজের দিবা বিভাগ ও নৈশ বিভাগের ক্লাস— মানে, দিবারাত্র ব্যস্ততা। এসময়ে বাবা কিংবা মা, কারও স্নেহ জাতীয় পদার্থের কোনো কথাই আমার স্মরণে নেই। তবু আমি তো ২ বছর অতিক্রম করে ফেলেছি। তার কিছুদিন আগেই বাবার হাত ধরে আমরা পা দিয়েছিলাম বাবার নিজের বাসায়, চন্দনপুরায়। এখনও কবি হেনরী স্বপন সহ অনেকেই সেই ঠিকানা মুখস্থ বলেন ‘১১৫ মনুমিয়াজি লেন, চন্দনপুরা, চট্টগ্রাম’।
লিটলম্যাগ বিন্দু bindu.bangmoy.com
ছোট বোন লীনা’র সাথে। |
লিটলম্যাগ বিন্দু bindu.bangmoy.com
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের আগের তেমন কোনো স্মৃতিই আসলে নেই। ১৯৭০ সালে আমার দাদা ফুসফুসের ক্যান্সারে মারা যান। আর ১৯৭১ সালের শুরুতে মারা যান আমার নানা। জেনেছি, আমার নানার চেহলাম উপলক্ষে আমাদের ভাইবোন দুজনকেই নিয়ে বাবা-মা এক কাপড়ে ফতেয়াবাদ নানাবাড়ি গিয়েছিলেন ২৫ মার্চ। আর সেখানে রাত্রিযাপনের সময়ই যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। যুদ্ধ যখন শুরু হয়ে গেল, ইয়াহিয়া খান ভাষণে নাকি বলেছিল “আমার মানুষ দরকার নেই, আমার দরকার জমি।” এমন কথা শোনার পরে আমার বাবার ঘরেবাইরে লোটকম্বল অবস্থা সূচিত হয়েছিল। এতোটাই ঘাবড়ে গিয়েছিলেন যে, যখন একটু শোর উঠতো, ওপাড়ায় মিলিটারি এসেছে — সাথে সাথে নাকি আব্বা আমাকে কোলে নিয়ে আর টাকার ছোট্ট ব্যাগটি নিয়ে ছুটে পালাতেন খাল বিল জংলার দিকে।
লিটলম্যাগ বিন্দু bindu.bangmoy.com
পূর্বাহ্ণ ২:৫১
অসাধারণ একটি পেজ।
উত্তরমুছুন