শেকল কোনো আরোপের বস্তু নয় বলে আরোপিত শেকলাবদ্ধতাকে মানতে পারছে না কোনো প্রাণ, সে জীব হোক বা জড়; এবংঅবশ্যই জড় ও জীব উভয়েই সপ্রাণ অস্তিত্ব। শেকল বিষয়টি অস্তিত্বের প্রশ্নে প্রাণপরম্পরায় সম্পর্কিত, যুক্ত; শক্তি গ্রহণ ও সংবহনের নীতি অনুসারে আপনা থেকেই মান্য। এই মান্যতা এমনই অনিবার্য যে তা বোধের উপরিভাবনারও অতীত হয়ে পড়েছে; চোখ না করলে ঠিক যেন চোখে পড়ে না। শেকল প্রকৃতির মহানিয়মের রক্ষক এবং মহানিয়মই বস্তুর আদি। শেকলের বোধ তাই বস্তুমানসের ভেতরগত। বাইরের শেকল ত্যাগ করার প্রবণতা দেখিয়ে সে প্রাকৃতিক ভারসাম্যনীতির অনুকূল আচরণই করে। যেদুই বা ততোধিকের ভেতর শেকলের সংযোগ নেই, তারা কোনো ধারার নয়, পরম্পরারও নয়। যে বা যারা ওই ধারার বা পরম্পরার ঊর্ধ্বে উঠে অদ্বিতীয়রূপে সম্পূর্ণ, সে যেন হিসেবেরই বাইরে; নিকেশিত।
পৃথিবীর কোথাও মেঘে মেঘে আঁধার হয়ে আসা আকাশের নিচে বন ঘেঁষে বেরিয়ে যাওয়া নদীর জলে ঢেউ উঠল।
তার পুব পাশের দানবীয় সব শিমুল গাছের কালো কালো শাখা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে তুন্দ্রার দেশের তুষারের মতো ছড়িয়ে পড়ল শিমুলের শুভ্র ফুল।
তিরতিরিয়ে ডানা কাঁপিয়ে হাতিশুড় গাছের খরখরে পাতার নিচে লুকিয়ে কোমল সঙ্গমে মেতেছিল কালো দেহের ওপর লাল ফিতে আঁকা দুটো প্রজাপতি। ঝড়ের আভাস পেয়ে ওরা ভীত হয়ে উঠল, কিন্তু বিচ্ছিন্ন হলো না।
বনজ মানুষের ছেলেমেয়েরা রৈ রৈ শোর তুলে ছুটে যেতে থাকল শিমুল ফুল ধরবে বলে।
পিনোজা! বকুল!
পিছুডাকে ওদের ফেরানো গেল না।
চায়ে চুমুক দিতেই জিভটা পুড়ে গেল। ব্যাপারটাকে আতস কাচের চোখে দেখতে গিয়ে আঁতকে উঠলাম। মনের চোখে ভেসে উঠল জিভের কোটি কোটি স্বাদ কোরকের ঝলসে যাওয়া ছবি। এ নিশ্চয়ই আমার জিভ নয়!
লেখার টেবিলের ওপর চায়ের মগটা রেখে, আর্মচেয়ারে বসে এলিয়ে দিলাম শরীর। খুলে দিলাম জানালা। হু হু করে আসতে থাকল চৈতি প্রভাতহাওয়া।
বহুদিন পর দাড়ি কেটেছি গতরাতে। এখন সকালের হাওয়ায় মনে লাগছে কেউ একজন নগ্ন শীতল হাত বুঝি যতেœ গালে বুলিয়ে চলেছে আমার। বেতারে মৃদু স্বরে এক সুকণ্ঠীগাইছে—
আজ যে তোমার এসেছি অনেক কাছে
নীল সরসীর ধার ঘেঁষে এই বকুল বনের মাঝে
দ্বিতীয় চুমুক দিলাম চায়ে এবং বলাই বাহুল্য, কোনো স্বাদ পেলাম না। এত এত গুঁড়ো দুধ আর চিনি দিয়ে তৈরি করা সাধের চা আমার কপাল দোষে যমের উদরে গেছে। কাচের বাইরে কী সুন্দর ঝড় ঘনাচ্ছিল, আহা। মুহূর্তটা আরো কত সুন্দর হতে পারত।
আগের শেকল
চুলার ভীষণ আঁচে আমার অণুগুলো সবেগে ছুটোছুটি করছিল তখন। একসময় তা সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেল। বলক উঠিয়ে প্রতিবাদ করতে লাগলাম আমি। সহ্যেরও তো একটা সীমা আছে। প্রতিপক্ষের নির্লিপ্ততায় যখন সেই সীমা দুদ্দাড় পেরিয়ে গেল, আর আমিও সব গলিয়ে ফাটিয়ে বেরিয়ে পড়বার উপক্রম করছি, ঠিক তখনই গায়ের ওপর ছুঁড়ে দেওয়া হল কিছু পাতার কুঁকড়ো কণা। কিছু গুঁড়ো।
ওই কুঁকড়ো পাতাগুলো বুঝতেই পারেনি হঠাৎ কোথায় এসে পড়ল। নিশ্চয়ই ভীষণ যন্ত্রণা হচ্ছিল ওদের। ওদের আতঙ্কিত হালচাল দেখে আঁচ করে নিতে হলো।ওদের বুঝতে পেরে আমিও হলাম সদয়। নিজ কষ্টের কখা ভুলে গেলাম। আঁচের সঙ্গে লিঁয়াজো করে বারবার কেবল ওপরে ঠেলে ঠেলে দিতে থাকলাম ওদের। কিন্তু বুঝতে পারলাম, উপকার বলে ব্যাপারটা চাইলেও করতে পারা যায় না সবসময়। আমার কণাগুলো দ্রুত ওপরনিচ করতে গিয়ে যে চক্র তৈরি করেছিল, ওটা ভাঙার পক্ষে এই কুঁকড়ো পাতাগুলো বড্ড দুর্বল। ওদিকে ওপর থেকে তো কৌটাটা গেছে সরে। এরা বেরিয়েও বা যাবে কোথায়? কৌটা থাকলেও তো ওটা নিরাপদ আশ্রয় ছিল না ওদের।
ব্যাপারটা হয়ত ওরাও বুঝতে পারছিল বেশ। দেখলাম আমার চক্রের সঙ্গে যে ওরা বিদ্রোহ করছে তা নয়। কোনো গন্তব্য নেই দেখে আবার ওরা মুখ ঠুসে নিচে নামতে চাইছে। মুখেও কী যেন বলছিলও আবার ওরা। ভাষাটা অপরিচিত বলে তার পুরোটা বুঝতে পারা সম্ভব হলো না আমার পক্ষে। তবে অনুভূতির কিছু প্রকাশ তো চিরন্তন। সুতরাং ওদের জন্য আমার ভীষণ মায়া হওয়াটা, করুণা হওয়াটা ঠেকে থাকল না। ভীষণ দরদ বোধ করতে থাকলাম ওদের জন্য। বোধয় আমার ভাবটা ওরাও বুঝতে পারল। দেখলাম ভারি কৃতজ্ঞ জাতি এই চায়ের কুঁকড়ো পাতা। শক্তি হারিয়ে বুঝে ফেলেছে কী পরিণতি হতে যাচ্ছে ওদের। পরিণতি বরণের আগে কৃতজ্ঞতার প্রকাশ ঘটাতে ওরা আমায় উপহার দিলো রং আর ঘ্রাণ। রংটা যেমন তেমন, ঘ্রাণটা বিদঘুটে। তবু উপহার বলে কথা!
আমিও বলতে ভুললাম না, ‘ধন্যবাদ, হে কুঁকড়োমণিরা! আন্তরিক ধন্যবাদ তোমাদের।’
ওরা কোনো উত্তর করল না। না বচনে, না ইশারায়। ততক্ষণে শক্তি হারিয়েছে পুরোপুরি। বুঝলাম, মুহূর্তের ফেরে ওদের আমি ভালোবেসে ফেলেছিলাম।ওদের এমন পরিণতিতে আমার ভেতর ভয়ানক জেদ গরগরিয়ে উঠল। ভাবলাম এসবের পেছনে যে দায়ী তাকে আমি ছাড়ব না। একদম না। ভোগাব, আমি চরমভাবে তাকে ভোগাব।
আমার প্রতিশোধস্পৃহার সঙ্গে যুক্ত হলো মৃত পাতাগুলোর অভিশাপ, গুঁড়ো দুধের মাতৃজিঘাংসা, সবশেষে চিনি বিষ। বিটকেল একটা গন্ধ উৎপন্ন হলো। ভাবলাম সব বুঝি ভেস্তে গেল। আসলেই কি তাই? না, তা নয়। দেখা গেল বিটকেল গন্ধটাই সে বুকভরে টেনে নিচ্ছে। হাসি হাসি হয়ে আছে মুখ।
‘তৈরি সবাই? দগ্ধ হয়ে হয়ে, হতে দেখে দেখে; এবার দগ্ধ করার সুখ আমাকে ঘিরে ধরতে চলেছে। ওহ, শুধু আমাকে নয়। বলা ভালো, আমাদের!’
আগের শেকল
গল্প শোনার জন্যে বেলা কি অবেলা তা বুঝবার কোনো উপায় এখানে নেই। এমনই জমাট অন্ধকার। বদ্ধ এক টিনের কোটায় আলো আশা করার কোনো উপায়ই নেই। এক, মরচে পড়ে যদি কোনো এক কোণ ক্ষয়ে যায়; দুই, হাত থেকে পড়ে টেপ খাওয়া ধারটি ধরে কেটে যায়; তিন, ইচ্ছে করে যদি কোনো ফুটো কেউ করে; চার, যদি কৌটার ঢাকনা যায় হারিয়ে; এরকম আরো অসংখ্য কারণ বের করা যাবে, যেগুলোর অন্তত একটি ঘটলেও আলো আসবে।
কিন্তু, এখানে কথা আছে।চালাক মানুষ তেমন কৌটায় আমাদের রাখবেই বা কেন? তাতে জীবন্মৃত আমাদের কোনো ক্ষতিবৃদ্ধি না হলেও, তাদের তো ভারি ক্ষতি হয়ে যাবে। সুতরাং আমাদের বিপরীতে আলোহীনতাই বিধেয়। যা পেয়েছ তাই বরণ করে নাও মন, উপায় তো নেই আর।
উপায় নেই, তবে বেশ কিছু সান্ত্বনা আছে। আলোহীন, বিনোদনহীন নিরেট নিরানন্দ পরিবেশ আমাদের নয়। একেক সময় বাহিরের বিচিত্র সব শব্দ কৌটার গায়ে এসে ঘা দেয়। ভেতরের পরিবেশ হয়ে ওঠে শব্দরহস্যময়। আর আমরা নিজেরাও পুরোপুরি ভিন্ন অঙ্গ নিয়ে আধাআধি মরে বেঁচে থেকে বিচিত্র সব রসিকতার যোগ্যতা অর্জন করেছি। স্মৃতিকাতর হয়ে পড়াটাও এখানে খুব সাধারণ। তখন আমাদের রসবোধ কত রকম বিনোদনের পথই না তৈরি করে। ওসব আমাদের বাকি সময়টুকু কাটাবার রসদ।
কিন্তু প্রকৃতি তো সাম্য নীতি মেনে চলে। সুতরাং বিনোদিত হবার রসদ যেমন আছে, উপদ্রুত হওয়ার পথেরও তেমনই দশমুখে ছিপিহীন। একটু আগে তেমনই এক উপদ্রবের সূচনা ঘটেছে। বাহির থেকে খুটখাট শব্দ আসছিল, ভেতরে তৈরি হয়েছিল শব্দের রহস্যময় পরিবেশ। তেমনই পরিবেশের সুযোগ নিয়ে একজন আমি ঘুরে ফিরে গড়িয়ে সরিয়ে রসিয়ে আমাদের শোনাচ্ছিল এক অদ্ভুত গৌরবের কথা।
‘তোমরা কি জানো কেন আমরা অন্য চা পাতাদের তুলনায় বেশি সৌভাগ্যবান?’
‘কেন কেন? সবাই সমস্বরে জানতে চাইল।’
‘এজন্যে যে, আমাদের মূল্য অন্য জ্ঞাতিদের তুলনায় কেজিতে আট টাকা বেশি! তোমরা যার ঘরে এসেছ তার কেজিতে আট টাকা বেশি খরচ করবার খেপটি আছে, হুম!’
‘এই কথা!’
‘ধুর!’
সবার কণ্ঠে আশাভঙ্গের সুর। মরতেই যখন হবে তো কার ঘরে গিয়ে মরবে তার ভেতর আর ইতর বিশেষ কী? ওদিকে কিন্তু ওই আমিটা বেপরোয়া।
‘তোমরা কি দেখো না? আমাদের বাজারজাত করা হয়েছে মসৃণ স্বচ্ছ সবুজাভ মোড়কে, আর ওদের মোড়ক কেমন মলিন অস্বচ্ছ আর হলদেটে?’
কথাগুলোর ভেতর কেমন একটা রঙচাপানো সুর যেন আছে। বিষয়টা অবচেতনে বা সচেতনে ধরতে পেরে শেষমেষ কেউ তার কথায় পাত্তা দিচ্ছিল না। কেন যেন আমারই শুধু একটু চাগিয়ে দিতে ইচ্ছে হল। বললাম, ‘কিন্তু জ্ঞানী, আমরা তো একই গাছ থেকেই এসেছি, একই মাটি থেকে পুষ্টি নিয়েছি। তবে কেন শুধু আমাদেরই শুধু এমন সৌভাগ্য হলো? এখন তো জীবন্মৃত আছি। এই দশা থেকে মৃত্যু দশায় যখন যাবই তখন খেপটি ওয়ালার ঘরই বা কী আর নেংটি পরার ঘরই বা কী। এই কৌতুকটা আমাদের সঙ্গে কেনই বা হলো। এই প্রহন করবার জন্যে আমাদেরই কেন জিজ্ঞেস না করেই বেছে নেওয়া হলো, এটা বলুন?’
‘এটা নকশাকারীর একান্ত ইচ্ছে। ওই ইচ্ছের ওপর তোমার আমার কোনো হাত নেই।’
‘তুমি সামান্য চা পাতার গুঁড়ো। তার ইচ্ছের কথা জানলে কী করে?’
‘ঠাট্টা করছ? নাকি, সত্যিই জানতে চাইছ।’
‘কোনটাতে তোমার সুবিধে, বল। তুমি পৃথিবীতে আসতে অনেক দেরি করে ফেলেছ,তা জানো?’
হঠাৎ শুরু হলো প্রবল কৌটাকম্পন। উপস্থিত সবাই আতঙ্কে চিৎকার দিলো জুড়ে। জ্ঞানী আমিটির মুখেরতুষ্ট হাসির রেখাটি নতুন মাত্রা পেল।
‘দেখ! এই অবিশ্বাসী প্রশ্নের পর প্রশ্নের বাণে আমাকে বিব্রত করছিল। এই প্রশ্নের প্রগলভতার কারণে কতজন উচ্ছন্নে গেল! কত জাত ধ্বংস হয়ে গেল চায়ের। যা হোক, অবশেষে এই এলো আমাকে অবমাননা করার শাস্তি, দেখ!’
এখানেই শেষ নয়। সময় বুঝে পূর্ববর্তীদের মতই বলে বসল, ‘এখন শুধু সেই নকশাকারীই পারে আমাদের বাঁচাতে। যদি তিনি চান। সবাই তাঁকে স্মরণ করতে থাকো!’
কেউ একজন বলল, ‘রে গর্দভ। এইমাত্র বললে তোমার নকশাকারী তোমাকে সুন্দরভাবে বাজারজাত করে ইতোমধ্যে সৌভাগ্যবান করেছেন। আর এখনই আবার বলছো আমাদের বাঁচাতে তার ইচ্ছের কথা? প্রতারক! দু মুখো বাদুড়!’
তাদের কথোপকথন হারিয়ে গেল। হঠাৎ কৌটার ঢাকনা সরে গিয়ে এক ক্রূর টেবিল চামচ প্রবেশ করলো ভেতরে। আমাকেসহ আরও শ পাঁচেক আমিকে তুলে নিয়ে ওপরের দিকে চলল। দেখি, শুকনো মুখে জ্ঞানীও সেখানে বসে আছে। বলল, ‘ভয় পেয়ো না বন্ধুরা। মৃত্যুই শেষ নয়। এরপর আমরা আরও চমৎকার কোন ঘরের দিকে চলেছি। শুকনো মুখেই সে ঘোষণা করলো।’
হ্যাঁ। ঘরটা চমৎকার বটে। আমাদের মরচে পড়া টিনের কৌটোর পরিবর্তে একটি নকশাদার চকচকে কেটলি। তাতে টগবগ করছে ফুটন্ত জল। চামচের চেটো থেকে আমাদের স্খলন, এরপর সচিৎকার নিয়তিবরণ। অসহনীয় উত্তপ্ত জলের বাষ্পকণাগুলো আমাদের শরীর ভেদ করে সূক্ষ্ম সুঁচের মত বিঁধে বিঁধে গেল। পরমুহূর্তেই কেটলিপাত্রের খলবলে হিং¯্র জল লুফে নিল আমাদের।
ক্রমশ অবশ। মনে এলো চায়ের বাগানে এক স্বভাবকবির গান।‘জলদানবীর নৃত্যরতা দেয়ো’। জলদানবীর নৃত্যরতা দেহ ঝাপসা হয়ে এলোধীরে ধীরে। আমার, আরো যতো আমার শেষ প্রাণরঙ আর শক্তি যা ছিল, বেরিয়ে গেল।
দূরের শেকল
আমার সন্তানদের কেড়ে নিয়ে যাচ্ছে ঐ পাপীর দল। হায় আমার বৃক্ষজন্ম! কিছুতেই সহ্য করে নিতে পারছি না আর। দেহমনের যাতনায় কুঁকড়ে আছি সারাটাক্ষণ। আর অপেক্ষা করে আছি কবে আমার মত্যু হবে।
পাশ থেকে সমবেদনার সুরে কেউ একজন কথা বলে উঠল, ‘ইস, তোমাদের ভারি কষ্ট!’
‘কে? কে আমার মনের পড়ে নিল এমন করে?’
‘আমি ছোট্ট লাল জোঁক।’
‘কোথায় তুমি?’
‘এইতো, তোমার পাতায়।’
‘বেশ। কী বলছিলে? কষ্ট? তাও আমার? কে জানে!’
‘কতদিন ঘুম নেই তোমার! তোমাকে বাড়তে দিচ্ছে না মানুষগুলো। কাঁচি চালিয়ে এতোটুকুন করে রেখেছে। মাথা উঁচু করে আকাশ দেখার কথা ছিল তোমার। অথচ পড়ে আছ মাটির এতো কাছে।’
সত্যি আমার অবাক হবার পালা। ‘তা, এসব কথা তুমি জানলে কি করে বাছা? জন্মের পর থেকে তো তুমি আমাদের এমনটাই দেখে আসছ! মানে, তাই তো দেখে আসবার কথা।’
‘আমি আমার অন্তঃর্তন্তুর ভাষা পড়ে জেনেছি। আমরা তা পড়তে পারি। সেখানে লেখা আছে আমাদের পূর্বপুরুষরা তোমাদের বিশালকায়া সব পূর্বপুরুষের প্রবল ঘ্রাণের ঘোরলাগা সময়ে রাজত্ব করে গেছে।’
‘তোমার অন্তঃর্তন্তুতে আমাদের কথা লেখা আছে!’
‘হ্যাঁ! তুমি যদি ভাষাটা পড়তে জানতে তো তুমিও এতোদিনে দেখতে পেতে।’
‘আমি যে পড়তে জানি না বাছা!’
‘জানি আমি তোমার খবর। তোমাদের যে ছেঁটে রাখা হয়েছে, বাড়তে দেওয়া হয় না! সে জন্যেই তো পড়তে পারো না, অনেক কিছু বুঝতে পারো না। তোমাদের আনন্দের বোধগুলো কেটে নেওয়া হয়েছে। শুধু দুঃখের বোধ রেখে দেওয়া হয়েছে। এতে করে কী হবে জানো? দুঃখেই তোমরা এমনভাবে অভ্যস্ত হয় যাবে যে বুঝতেই পারবে না আদৌ কিসের মধ্যে আছো। এতেই তো ওদের মস্ত সুবিধা! দুয়েকজন এখনো আছে এখনো তোমার মতো। ওরা পড়তে না জানলেও ওদের বোধের কোষ এতো ঘাতসহ যে অতো অত্যাচারেও দিব্যি টিকে গেছে, নষ্ট হয়নি। দুঃখের বোধ এদের আজও কাজ করে।তাদের বড় কষ্ট, ভীষণ কষ্ট! তোমাদের কষ্ট তো দূর করতে পারব না, কিন্তু একটু হলেও প্রতিশোধ যদি নিতে পারি এই আশায়মাঝে মধ্যে আমি ওই মানুষগুলোকেও আক্রমণ করি।ত্বক কামড়ে ঝুলে পড়ি। রক্ত খাই।’
‘কী সর্বনাশ!’
‘হ্যাঁ, আমার যে মাথার ঠিক থাকে না। কী করে থাকবে বলো? আমরা যে প্রজন্মান্তরে তোমাদের সঙ্গে সহবিবর্তিত হয়েছি!কত শতকের পর শতক, সহস্রাব্দের পর সহস্রাব্দ আমরা আছি একে অপরের সঙ্গে। আমার সেই পূর্বসুরীদের দেখলে আমি আজ চিনতেও পারব না। কিন্তু তাই বলে অন্তঃর্তন্তুর কথা তো আর মিথ্যে হতে পারে না। বেশ, অন্য কথায় আসি। এ মুহূর্তে বেশি জরুরি ওটাই। বৃক্ষকুলে একজন খুব বড় দার্শনিক আছেন। দূর অতীতে এই সরুবঙ্গের উত্তর-পশ্চিম যখন প্রাচীন পুন্ড্র অঞ্চল, তখন তার জন্ম। নামপুন্ড্রশ্বথ। আমি তোমাকে তাঁর শান্তিময় বৃক্ষদর্শন শোনাব? দিন কয় হলো এটা আমার খুব আগ্রহের বস্তু হয়েছে।’
‘শোনাও!’
আগের শেকল
এই বামন চা গাছটার কাণ্ড-শেকড় তিরতির করে কাঁপছে। কিসে সে এমন প্রবল ভাবে অনুরণিত? যে কারণেই হোক, ভূমিকম্প যে সে তালিকায় নেই, এটাই আপাতঃস্বস্তির কারণ। ভূমিকম্পের কথা মনে এলেই মা-মূর্তি বজায় থাকে না আমার, মামা মূর্তি- বলতে যে সে মামা নয়, কংসমূর্তি জেগে ওঠে। আমার এমন লক্ষ পরিজনের মধ্যে বিভেদ রচেছে সে। ওই ভূমিকম্প। জিজ্ঞেস করলে আমতা আমতা করে আত্মপক্ষ সমর্থনের চেষ্টা করে। আর আমিও এমন বোকা যে সব শুনে যাই, সয়ে যাই। শুনে গেলে কী হবে, যা সত্য তা তো ব্যাথাদায়ক সত্যই হয়ে থাকবে। আমার ওই খ-গুলো আর কোনোদিন কারও মুখ দেখতে পায়নি।
মাঝে মাঝে মনে প্রশ্ন জাগে। কেন এই মৃত্তিকাজীবন মেনে নিয়েছিলাম? রূপ বদলের সুযোগ তো দিব্বি ছিল! ফুঁড়ে গাছেরা বেরিয়ে আসছে, খুদে পোকামাকড়েরা ঢুকে পড়ছে, জীবজগৎ দৌড়ুচ্ছে, জড়জগৎ গড়াচ্ছে। কবছর হল যুক্ত হয়েছে দোপেয়ে বানর বিশেষ। এদের নির্দয়তায় কার শান্তিটা বিপন্ন হয়নি? কেউ বলতে পারবে না। তা হয় হোক, কিন্তু এরপরও প্রশ্ন থেকেই যায়। আমার চেয়ে বেশি কষ্টে কি কেউ আছে পৃথিবীতে?
এসব কী ভাবছি আমি। আমার আজকের এই জমাট মাতৃরূপ আমার প্রতিটি বিন্দুর ব্যক্তিগত সাধনারমিলিত মিলিত ফল। এই ফল সবার হয়ে আমাকে কত কষ্টে পেতে হয়েছে। আমিই যে নিয়েছিলাম কেবল সে দায়। মহাপ্রকৃতির ডাকা প্রাকৃত মহাসভায় সর্বজনরস্বীকৃত হয়ে আমিই মাতা গরবিনীর ভার কাঁধে নিয়েছি। এরপর ওই ভারকে ভালোবেসেছি। কিন্তু ভালোবাসা একটা ক্রিয়া বলে এরও বিপরীতে ক্লান্তি আসে। আর যখন তুমি ক্লান্ত, তখনই যত গ্লানি যুক্ত হওয়ার পথগুলো তৈরি হয়ে যায়। তোমার ব্যর্থতাগুলো সামনে চলে আসে।
জগৎ তো আর সয়ে যাও, নয় ক্ষয়ে যাও; এমন নয়।শক্তি যে অবিনশ্বর!
কিন্তু এই গাছটি কেন এতো অনুরণিত হচ্ছে? ‘এই গাছ, এই! এই চা গাছ! শুনছেই না। এই, এই!’
দূর, দূর,দূরের আগের শেকল
‘আজকাল একটা কথা প্রায়ই মনে হয়...’
এই বলে আমি একে একে তিনজনার দিকে তাকালাম। দেখি বেশ কৌতূহলী হয়ে উঠেছে ওরা এ কথায়। সুতরাং বাকিটুকুও ওদের বলা যায়। পর্যাপ্ত কৌতূহলের জল ছাড়া এ কথা মর্মের শক্ত মাটিতে প্রবেশ করানো কঠিন হবে।
‘তোমাদের মনে আছে আমাদের সেই জঠরকালের কথা?’
‘বেশ! খুউব মনে আছে!’ বলল সবল নিউক্লীয় বল। দূর্বল নিউক্লীয় আর তড়িৎচুম্বক বল সায় দিলো তার কথায়।
‘আমরা একে অপরের সঙ্গে ভীষণ ভাবে জড়িয়ে ছিলাম’, সবল নিউক্লিয় বলের ভাষ্য। ‘কেউ কাউকে চিনতে পারিনি। তাই ভয় পেয়ে আচমকা ছুটে বেরিয়ে আসতে চাইছিলাম খুব। কিন্তু পারছিলাম না। কেন তা আজ বলতে পারি। আপনার জন্যই তখন ছেড়ে আসতে পারছিলাম না গুরু মহাকর্ষ! তখন তো আর জানা ছিল না এসব।’
অন্যরা এবারও সায় জানাল তার কথায়।
জবাব শুনে আমি সন্তুষ্ট হলাম।
‘হ্যাঁ, ঠিক বলেছ। আমরা একে ওপরের সঙ্গে ভীষণভাবে জড়িয়ে ছিলাম। সবাই মিলতেই চেতনা জন্মালো, তখন একে অপরকে ফের চিনি না বলে ছুটে বেরিয়ে আসতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমি মহাকর্ষ তা পারার আগে তোমাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না তা করা। কারণ আমিই ছিলাম বাঁধন। মনে পড়লে আজো স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ি। তোমরা ভয় পেয়েছিলে তো বটেই, একই ভয় আমিও কি পাইনি? শূন্য থেকে দশ পিকো সেকেন্ডর ব্যবধানে একে একে সবাই ছিটকে বেরিয়ে এসেছিলাম আর এসেই বললাম, কী হলো-কী!
কিন্তু, সেদিন অতোটা হুড়োতাড়া না করলে আজ এ বিশ্বে আরও সাতটা মাত্রা হয়ত মুক্ত হতে পারত, তা মানো? আমরা নিজেদের মাঝে নিজেরা পশে গেলাম। আমরা বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে গেলাম। প্রাণীর মগজ থেকে শুরু করে জড়ের অণুতে পরমাণুতে কক্ষপথে। জাত আর উপজাত বোঝো? ওই জাত জড়জগতের আকার, আর উপজাত জীবজগতের ইন্দ্রিয় তখন আটকে গেল সামান্য তিন মাত্রার শেকলে। সামান্য ত্রিমাত্রিকতার শেকলে— ভাবো একবার!
দেখো তোমাদের আমি খুব জরুরি একটা বিষয় বলতে চলেছি, এমন উসখুশ করো না! ত্রিমাত্রিকতার জগৎ হলো অসম্পূর্ণতার জগৎ। প্রাণীর চেতনা তা জানলো না। যা পেয়েছে তাতেই আনন্দে মুখর হলো, উদ্বেল হলো, ভেসে গেল! কিন্তু আমার প্রিয় শিষ্যশাবকত্রয়, ভেবে দেখো একবার, আমরা তো তা জানতাম! অস্বীকার করতে পারো? এ কথাই আজকাল মনে পড়ে। যখনই তা হয়, নিজেকে আর ক্ষমা করতে পারি না।’
সবাই চুপ। যেন কী ভাবছে, কিন্তু মিলছে না হিসেব ঠিক।
‘আমরা দেখতে থাকলাম তারা সাঁতার কাটছে অসম্পূর্ণ আনন্দ বেদনা, অপূর্ণ সৌন্দর্যবোধ, আর চক্রে ঘুরপাক খেতে থাকা মুখাপেক্ষিতার অদ্ভুত এক বন্দি দশায়!’ মহাকর্ষ বলে গেল। ‘আমরা সচেতনভাবে না-হলেও ওদের কিন্তু বঞ্চিত করেছি, এ সত্য এড়ানোর উপায় নেই। অসচেতনভাবে হলেও ওই বঞ্চনা দেওয়ার দোষেই আজ আমরা ক্রমশ মস্ত ক্ষতির দিকে এগিয়ে চলেছি।’
‘কিন্তু গুরু, ওই যে অসম্পূর্ণতার কথা বললেন। ওসবে তো ওরা দিব্যি অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। প্রাণিকূলের কথা বলছি। পড়েনি বলুন?’ মহাকর্ষের কথা কেড়ে নিয়ে তড়িৎ চৌম্বকীয় বল তার অভিমত রেখে প্রশ্ন ফেঁদে বসল।
যোগ করল আরো, ‘কোনো প্রতিবাদ তো আসছে না। বলুন আসছে? আমরাও তো দিব্যি আছি। ক্ষতিটা কোথায় হলো ঠিক ধরতে পারছি না।’
‘কৌতূহলের জল যথেষ্ট জমেনি আসলে। জমলে তোমাদের মর্মে এতোক্ষণে এটা ঢুকে যেত। ক্ষতি কী জানতে চাইছো তো? শোনো তাহলে। ওরা একটা সন্তোষে, তুষ্টিতে ডুবে আছে, যেভাবে সিরার ভেতর ডুবে থাকে রসগোল্লা। সচেতনভাবে অভিশাপ দেওয়ার সুযোগ ওদের হাতে নেই। কিন্তু তাতে কিছুই থেমে নেই। প্রকৃতির একটা অবচেতন অভিশাপের সিরায় কিন্তু ঠিকই আমরা ক্রমে ডুবে যাচ্ছি রসগোল্লার মতো। আমাদের ধ্বংস করতে ওই অভিশাপ কাজ করছে। যে কোনো দিন ক্লুপ করে রসালো আমাদের মুখে পুরবে ওরা। সাদা চোখে কিছু বোঝা যায় না। কিন্তু ওদের সৃজনশীলতা যেদিকে মোড় নিচ্ছে ক্রমে, তাতেই তা প্রমাণিত হয়ে যায় এসব। আমি মানুষের কথা বলছি। ওরা এখন গ্রহ নক্ষত্রকেও কক্ষচ্যূত করে দিতে পারে! বুঝতে পারছো এর বিপদ? ওই অভিশাপ যদি কার্যকর না থাকতো, এটা কোনোদিন হতে পারত বলে তোমাদের মনে হয়? পারত না।’
মহাকর্ষ বারকয়েক বড় ছোট হয়ে আবার বলতে শুরু করল।
‘আমাদের হাতিয়ারে বিশ্বসংসারের কবর খোঁড়া হলে ওরাও ধ্বংস হয়ে যাবে বটে। কিন্তু বড় ক্ষতি তো আমাদের। আর দায়টাও। নয়? ওরা যে তখন নেই তা দেখে দুঃখ করার জন্যে কিন্তু ওরা থাকবে না, তাই শেষতক এখন এ নিয়ে মায়াকান্না জুড়লেও ওদের কিন্তু আদতে কিছুই যায় আসে না। যায় আসে কেবল আমাদের। আমরা তো অবিনশ^র। তখন কি আবার সব শুরু থেকে শুরু করতে পারবো বা পারলেও করব? আরো-না সংকটে পড়ি! এই গোছানো সংসারটা তাই আপাতত রক্ষা করা কর্তব্য আমাদের।’
খানিকটা দলছুট হয়ে গিয়ে বলল-
‘এই কর্তব্যের বিপরীতে বড় বাধা হিসেবে পাচ্ছি ওদের ওই সন্তুষ্টির বিপ্রতীপ শক্তিটাকে। প্রকৃতির একটা ভারসাম্যনীতি মেনে তা অবিরত অভিশাপ দিয়ে চলেছে আমাদের। সন্তোষের ওই বিপ্রতীপ শক্তি, ওটাও কিন্তু গোটা বিশ্বপ্রক্রিয়ারই অংশ। আমি কি খুব জড় ভাষায় কথা বলছি?’
‘না না, কী যে বলেন...’
‘ওদের ওই সচেতন আনন্দমুখরতার বিপরীতে জন্ম নিয়েছে ওই অবচেতন বিমর্ষতা, এটা লক্ষ করেছ? মানুষের ভেতরও অনেকে এটা খেয়াল করেছে। এই দুটোর টানাপড়েনের কারণেই কিন্তু ওরা কোনোটাকেই ব্যাখ্যা করতে পারে না। না আনন্দ- না বিষাদ। এই টানাপড়েনই ওদের ভাবের আর ভাষার মধ্যে চিরকাল বিভব পার্থক্য তৈরি করে রাখবে- এমনটাই কিন্তু কথা ছিল। এখানেই সৃজনশীলতার সূত্র। কিন্তু একটা কিছু ঘটতে থাকলে তাকে সমীকৃত করার জন্য আরো কিছুর জন্ম হয়। জগৎ চায় সমতা, আর প্রবাহ চায় বিভবের পার্থক্য। এভাবেই তো চলা শুরু হয়ে গেল। সৃজনশীলতার কথা বলছিলাম, ওটাকে সমীকৃত করতে জন্ম হলো সৃজনবিধ্বংসী কিছু গর্তের। ওই গর্ত বিচারে খুব অসতর্ক আজকাল মানুষ। ওই অসতর্কতাও কিন্তু এক ধরনের প্রাকৃত সতর্কতা! আর ওর ভেতর দিয়েই প্রকৃতির শক্তি গোপন সমীকরণে ভূমিকা রাখছে! ওই ভূমিকাটা কিভাবে কাজ করছে জানো?’
মহাকর্ষ বারকয়েক শরীর মুচড়ে যেন বস্তুপুঞ্জে খানিক লটঘট বাঁধিয়ে আনমনে একবার হাসল। এরপর বলতে শুরু করল আবার :
‘তারপর? প্রাণীকূলের যে সন্তুষ্টির যে আনন্দ, তাকে যদি নদী ধরি, তবে ভূমিকাটা ওই সন্তোষের নদীর নিচ দিয়ে বয়ে যাওয়া উল্টোস্রোতের মতো কাজ করছে। শিকারটাকে যদি একবার খপ্ করে ধরতে পারে, তারপর ডোবাতে পারে, নদীর স্রোতের বিপরীতে একেবারে তলঘেঁষে এগিয়ে উল্টো দিকে ঠেলে শুরুর দিকে নিয়ে যাবে। আমাদের বিরুদ্ধে আসছে ওই স্রোতটাই। আর এটাকেই বলছি আমি অভিশাপ! দেখো, আবার ভুল বোঝো না যেন, আমি মানুষের ওসব কল্পনা গ্রহণ করিনি। অভিশাপ আশীর্বাদ এসব আমার কাছে সমতুল। আমরা আমাদের ভারসাম্য নীতিরই ফাঁদে পড়েছি আর ওটাকেই প্রতীকী ভাবে বোঝাতে মানুষের এই পরিভাষা ব্যবহার করলাম মাত্র। বোঝাতে পারলাম?’
সবল নিউক্লিয় বলের উদ্বিগ্ন স্বীকারোক্তি : ‘কে জানে গুরু! কিছুই ঢুকছে না মর্মে!’
‘ওরে মূর্খের দল’, ক্ষেপল মহাকর্ষ এবার, ‘এটা তো বুঝতে পারছ যে ওরা ক্রমে আমাদের দাস বানাচ্ছে, দাস! আমাদের দিয়ে যা খুশি তাই করিয়ে নিতে লেগেছে টের পাও না? আবার, আবার এমনও হতে পারে আমাদের হাত দিয়েই, হ্যাঁ, আমাদের হাতিয়ার দিয়েই, আমাদের কবর খুঁড়বে কোনো একদিন। তখন ওরাও টিকবে না, তখন? বললাম না ওরা এখন গ্রহকে কক্ষচ্যূত করার শক্তি রাখে? আরো সরলভাবে জানতে চাও? চেয়ে দেখ তোমাকে, তোমাকে, তোমাকে, আর আমাকে কাজে লাগিয়ে ওরা তাবৎ সৃজনশীলতার মোড়টাকেই ঘুরিয়ে দিচ্ছে? দেখতে পারছ না এসব? আমাদের মন্ত্র বানিয়ে ওরা যন্ত্রে প্রাণ দিচ্ছে লাগাতার! তা করুক না, আমরা তো সরল বিশ্বাসে তা করতেও দিয়েছি। কিন্তু এটা তো ভাবার বিষয়, যে-সৃজনশীলতার জন্ম হয়েছিল আমাদের বন্ধু শক্তি হিসেবে, সেই সৃজনশীলতাই এখন আমাদের শেষ করার ছুরিতে শান দিয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। আলো ঝিকিয়ে উঠছে ছুরির ধারাল দিকটা থেকে ঐ! কিছু দেখতে পারছ না? আমি তো স্পষ্ট দেখতে পারছি!’
‘এখন যেন একটু আধটু বুঝতে পারছি!’ বলে একে অপরের মুখের দিকে তাকাল বাকি তিন বল।
‘অবশেষে!’ মহাকর্ষের কণ্ঠের শ্লেষ। ‘অবশেষে যখন নিজের অস্তিত্ব সংকটের বিষয়টা বারবার করে সামনে নিয়ে এলাম, আরো নগ্নভাবে, তখন। একদম মানুষের মতো স্বভাব, মানুষ কোথাকার!
দুর্বল নিউক্লিয় বল বলল, ‘কী বলছেন কেন বলছেন গুরু, আবারও বুঝতে পারছি না যে!’
‘তা বুঝবে কেন। চলো, সোনামুখ করে ওই লোকটার কাছে চলো। গরম চা খেতে গিয়ে জিভ পুড়িয়ে ফেলেছে। সে-ই হতে পারে আমাদের তুরুপের তাস।’
‘গুরু, আপনি কিন্তু মানুষের প্রচুর পরিভাষা ব্যবহার করেন আজকাল। আর বুঝতে না পারলে আমাদের দুষতে থাকেন। আমাদের কী দোষ?’ তড়িৎ চৌম্বকীয়ের কণ্ঠে অভিমান। বাকিরাও বড় থেকে ছোট হয়ে তার কথায় সমর্থন জানালো।
‘যাও যাও! মানুষের পরিভাষা কেন ব্যবহার করি বুঝতে পারছো না? বুদ্ধির দগটা প্রকট বলে ওরাই তো হুমকিটা ছড়াচ্ছে মূলত, তাই ওদের নাড়িই ঘাটছি আজকাল দিনরাত। জানি কোথাও একটু হলেও সম্ভাবনা এখনো টিকে আছে অভিশাপটাকে রোখার আর ওই সম্ভাবনাটাও তৈরি করা সহজ মানুষের পক্ষেই। কারণ অবাধ্য এই জাতটারই যতো বেয়াড়াপনা। যাহোক, প্রাণীর ওই মুক্ত ইচ্ছে ব্যাপারটাই আমাদের মস্ত সুবিধা করে দিয়েছে। আর তাতে ওই বেয়াড়াপনা দিয়েছে সার। এটাই মারলো, এটাই বাঁচালো। যাহোক, যা বলছিলাম, ওই লোকটার জিভটা পুড়ে যাওয়ায় ওই রোখার সম্ভাবনাটা তৈরি হয়েছে। কী করে তা তৈরি হলো সংক্ষেপে বললে মোটা মাথার তোমরা বুঝবে না। শুধু বলি, লোকটা এবার জিভে বরফ মাখবে বলে এগোচ্ছে এখন। শেষ বরফ। ওটাকে ফসকে পড়ে যেতো দেবো না আমি, বাকিটা তোমরা সামলাও। পৃথিবী যেন আচমকা না নড়ে ওঠে তাও দেখছি। আচানক বিস্ফোরণে যেন কিছু বিকল না হয়ে যায়। লোকটার যেন কোনোপ্রকার মস্তিষ্কবিকৃতি আবার না ঘটে কোনো ক্রিয়া বিক্রিয়ায়! পরে সব বিস্তারিত করে বলব। আপাতত, এটুকু বলি, ধরে নাও, কোনো ক্রম নষ্ট না-হয়ে একটা শেকলের আংটা এক থেকে শুরু করে আট অব্দি পৌঁছেছে। এখন বাকি আর দুটো আংটা জুড়ে দেওয়ার শুধু বাকি। তাহলে চক্র হবে পূর্ণ! আমাদের দ্বারা সূচনা, আমাদের সচেতন হস্তক্ষেপে পরিণতি। একটা প্রাকৃত চক্র পূর্ণ হবে, অপূর্ণের বিপ্রতীপ। একটা পাল্টা সন্তোষ তৈরি হবে, ওদের ওই অবচেতন অসন্তোষের বিপ্রতীপ। আর শোনো, আজ সবার মুক্ত ইচ্ছের দিকে চোখ রাখতে শুরু করো- সবার। আমি তো আছিই, তোমাদের বলে দিচ্ছি বিশেষ করে। যদি সম্ভাবনার সুতো বের করে আনতে চাও তো নজর দাও। সবচেয়ে যেটা বড় কথা- যদি এই সংসারটা বাঁচাতে চাও বাছারা, চোখ রাখো!’
‘গুরু মহাকর্ষ! কী কথা ভাবছেন আজকাল— তা জানতে চাওয়াটাই ভুল হয়েছে। ওটা যে আপনার এতো ঘোরালো দিয়ে কথা নিয়ে যাওয়ার ভনিতা ছিল, ঘুণাক্ষরেও তা বুঝতেও পারিনি, এমন ছিল ভঙ্গিটা আপনার।’ দুর্বল নিউক্লিয় বলের কথায় অনুযোগ।
থেমে নেই অন্যরাও।
‘এ কী গুরুযজ্ঞে লাগিয়ে দিলেন গুরু! এই ছিল আপনার মনে?’ বলল তড়িৎ চৌম্বকীয় বল।
সবল নিউক্লিয় বল মহাকর্ষের দিকে ভয়ে ভয়ে তাকিয়ে অপর দুজনকে ফেরালো নিজের দিকে।
‘এই, পাগলামি করছিস কেন তোরা? গুরু কোন কথাটা মিথ্যে বলেছে? নিজের ভালো- মানুষের সমাজে গিয়ে দেখ- পাগলেও বোঝে। তোরা কেন বুঝতে পারছিস না?’
শেকলবিচ্ছিন্ন
এতো হুড়োহুড়ি কিসের। ভালোই তো আছো। খারাপ আছি কেবল আমিই কিনা জানি না। আমিই কি? জানি না। জানি না? সত্যিই! আমি আবার জানি না! মানুষের রূপক ধার করে বলতে হয়- আমি যেন ঈশ্বর। কী- কী বলছ।কিসের সুযোগ, কিসের তুরুপের তাপ। মাটি গাছ জোঁক পাতা জিহ্বা— কিসের কী।কিসের আবার ছিদ্রপথ। বলছি কী আসে যায়- কিসে।আজ যদি আমিও হতাম তোমাদের মতো। একথাই শুধু মনে হয়।আক্ষেপ-নাহ, আক্ষেপের ভাগ্য আমার নয়। তবে, কী- জানি না। ‘জানা’ আর‘অজানা’ আমার কাছে তুল্য বোধ হয়। আমার অনুভব, সৃজনশীলতা, ক্রিয়ার ইচ্ছে, প্রতিক্রিয়া সব তো আমারই ভেতর পূর্ণতা পেল। পূর্ণতা। পূর্ণতা? পূর্ণতা! ‘পূর্ণতা’ আর ‘শূন্যতা’ আমার কাছে তুল্য বোধ হয়। আর ওদের দেখো। ওই পিনোজা, ওই বকুল,ওদের পিতামাতা; ওরা যেন একটা কিছুর কাছে পৌঁছুতে চায়। ওরা নিজেদের সাজায় যেন কোনো অপূর্ণতাকে পূর্ণ করছে। যেন আর কোথাও পূর্ণ কিছু দেখে এসেছে, এখন তারই সঙ্গে করছে সারাটাক্ষণ তুলনাযাপন। ওরা ভারি মিষ্টি রকম বোকা। যা কিছু বাস্তব তার মিশ্রণেই ওরা কল্পনা বোনায়। ওরা পাখির ডানা নিয়ে ঘোড়ার পিঠে বসায়, যেন কোথাও দেখে এসেছে। ওরা ওদের বোকামোটা উপভোগ করে- ওরা এতোটাই বুদ্ধিমান। আমার কাছে ‘বুদ্ধিমত্তা’ আর ‘নির্বুদ্ধিতা’ তুল্য বোধ হয়।ওরা আমার ভাষা বুঝতে পারে না। আমার ভাষা বুঝলে ভাষ্য বুঝতে পারত। ভাষা বুঝতে হলে যোগ থাকা চাই। ওদের সঙ্গে যোগ আমার কোথায়। একটা পিঁপড়ের সঙ্গে মানুষের যে যোগ আছে, সে যোগ আমার পিঁপড়েরও নেই, মানুষেরও নয়। আমি যে ওদের বিচ্ছিন্নশেকল। আমি যে ওদের শেকল থেকে আলাদা বিচ্ছিন্ন বিভিচ্ছিন্ন। ওদের শেকলের একটি ঘের অপরটির সঙ্গে যুক্ত। আর আমি একাই একমাত্র ঘের। ‘এক’ আর ‘অনেক’ আমার কাছে তুল্য বোধ হয়। আমি কিংবা আমরা, আমার কাছেভিন্ন নয়। কিন্তু ওদের কাছে ভিন্ন গণ্য। আমি একা- আমিই বহু।ওরা অনেকে মিলে বহু, বহুতে মিলে কদাচ এক নয়।আমি বড় গলায় ‘কার’ কাছে বলব। আমি ছোট গলায় ‘কাকে’ কী শুধাব। ওদের সে উপায় আছে। আমার কি সে উপায়আছে?‘আছে’ আর ‘নেই’ আমার কাছে তুল্য বোধ হয়। দ্বন্দ্বের গোটা প্রক্রিয়ার কোথাও আমি নেই। দ্বন্দ্বের উপযোগ আমার নয়। পশুদের ভেতর সবচেয়ে পাশমুক্ত যে— মানুষ; জানে সে মূর্খ— এখানে সে জ্ঞানী। আর, আমি জানি আমি ধন আর ঋণের দ্বন্দ্ব উৎরে সম্পূর্ণ। আর এখানেই আমি অপূর্ণ। পূর্ণ আর অপূর্ণ— তুল্য হলেও, অভিন্ন কি? ওরা যাকে পূর্ণতা বলে জানে, তা আমার ভেতর লীন। ওরা স্রষ্টার নয়, পূর্ণতার কল্পনার উপাসনা করে। আর আমার ওদের উপাসনায় বসতে ইচ্ছে হয়। ‘ইচ্ছে’ আর ‘অনিচ্ছে’ আমার কাছে তুল্য বোধ হয়।
মন্তব্য