যুদ্ধ থেকে ফেরার পর নিজের বাড়ি খুঁজে না পেয়ে ছেলেটা সিদ্ধান্ত নেয় সে কারো বাড়ি দখল করবে। ব্যাপারটা সহজ ছিল না। বাড়ি দখল করা একা যেমন সম্ভব নয় তেমন সেই দখল করার মানসিকতাও থাকাটা পূর্বশর্ত। এই দুই পূর্বশর্তে ব্যর্থ হয়ে ছেলেটা নিজের থাকার জায়গা নিয়ে ভাবতে থাকে। গত কয়েকমাস ফিল্ডে থেকে সে ভুলে বসেছে তার নাম থেকে শুরু করে প্রায় সব। কেবল শহরের নাম মনে ছিল আর মনে ছিল নিজেদের বাড়ির কথা। বাড়িটা ছিল একতলা। পাশে ছিল একটা আমগাছ। একটা না দুটা আমগাছই থাকত কিন্তু যুদ্ধে যাওয়ার আগেই এক ঝড়ে সেই আমগাছটা ভেঙে পড়েছিল। পুরোনো স্মৃতি বলতে শুধু এতটুকুই তার অক্ষত ছিল।
শহরে এসে নিজের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে দেখে যে আমগাছটা ভেঙে গিয়েছিল সেই গাছটা দিব্যি শুয়ে আছে আর কোথাও কিছু নেই। যেখানে বাসা ছিল সেখানে এখন কিছুই নেই। এমনকি কেউ যদি ভেঙে ফেলে থাকে সেই লক্ষণও নেই। অর্থাৎ কোথাও ইটের টুকরো ছড়িয়ে ছিটিয়ে নেই। প্রথমে অন্যের বাড়ি দখল সংক্রান্ত চিন্তায় এবং পরবর্তীতে নিজের স্মৃতি বিষয়ক জটিলতায় আক্রান্ত ছেলেটা ক্ষিদে টের পায়। তার হাতে অর্থকড়ি নেই সুতরাং খাওয়ার চিন্তাটাও তাকে কাবু করে ফেলে।
স্মৃতি হারিয়ে ফেললেও মৌলিক অধিকার বিষয়ক অনুভূতিগুলো তার অবশিষ্ট আছে ভেবে সে অবাক হতে চাইলেও ব্যর্থ হয়। সম্ভবত বিস্মিত হওয়ার স্মৃতিও তার ভেতর থেকে লোপ পেয়েছে। যুদ্ধকালীন স্মৃতি তার যথেষ্ঠই আছে এবং তার মনে পড়ে সর্বশেষ কোনো এক গ্রামে সে লাউ আর ভাত খেয়েছিল। সঙ্গে ছিল তার এক বন্ধু কিংবা সহযোদ্ধা। যথারীতি সহযোদ্ধার নাম তার মনে নেই।
সে শহরে রাস্তায় হাঁটতে শুরু করে। কেউ তার দিকে চোখ তুলে তাকায় না। কোথাও তার একটাও পরিচিত মানুষ চোখে পড়ে না। তখন তার মনে হয় সে একটা পাখির বাসা দখল করতে পারে। কিন্তু পাখির বাসা সম্পর্কিত কিংবা পাখি সম্পর্কে কোনো স্মৃতি না থাকায় তার সেই চিন্তাও ব্যর্থ হয় এবং ক্রমেই তার ক্ষিদে বাড়তে থাকে।
কতদিন না খেয়ে আছে ছেলেটা?
এমন একটা প্রশ্ন তার ভেতরেও আসে এবং তখন সে দেখতে পায় তার সেই সহযোদ্ধাকে যার সঙ্গে সে শেষবারের মতো লাউ আর ভাত খেয়েছিল।
তাকে সে ডাক দিয়ে ও কথা বলে বুঝতে পারে, সহযোদ্ধাও একই রকম সমস্যায় পড়েছে। কী করবে দুজনে বুঝে উঠতে পারে না।
এবার তারা একটি বাড়িতে ঢুকে যায়। দরজায় নক করে কিন্তু কেউ দরজা খোলে না। প্রথম ছেলেটা দরজায় লাথি দিলে চাইলে পরেরজন তাকে ফেরায়। সম্ভবত বাড়িটিতে কেউ নেই।
তাহলে আমরা এখানে থাকতে পারি? দুজনের চোখ পরস্পরকে প্রশ্নটা করে।
তারা সিদ্ধান্ত নিতে পারে না তবে বের হয়ে আসে। বের হয়েই সহযোদ্ধা আরেকজন পরিচিতকে পায় যে কিনা তার সঙ্গে যুদ্ধ করেছিল। এই তৃতীয়জন ও নাম ভুলে গেছে, বাসার ঠিকানা মনে ছিল, গিয়ে দেখে সেখানে বাসা নেই।
এবার তিনজন বলে ভাবতে থাকে কী করা যায়।
যুদ্ধ শেষে আমরা কোথায় এসে পড়লাম?
প্রথমজন বলল, এটা সম্ভবত নরক। আমরা মারা গেছি।
বাকি দুজন বিষয়টা মানতে রাজি হয় না। একে অপরকে চিমটি কেটে দেখে এবং টের পায় ব্যথা লাগছে।
আর কয়েক ঘন্টার ভেতরেই পুরো শহরে স্মৃতি ভুলে যাওয়া অনেক যোদ্ধার দেখা তারা পায়। তারা সকলে একটা পুকুর পাড়ে গিয়ে বসে, যেই পুকুরটা খটখটে শুকনো।
তখন কেউ একজন বলে, সম্ভবত সকলেই মরে গেছে, শুধু যুদ্ধটাই বেঁচে আছে।
মন্তব্য