মড়ক সংবাদ ১
কত মধুর করে তোমরা মিথ্যাচার করতে পারো!
আমাদের সমবেত বেদনার দিকে তাকিয়ে—
তোমরা আলস্যের হাসি হাসো।
কী অসাধারণ সেসকল অভিব্যক্তি!
আমরা জনতা, মাথামোটা ও বিবেচনাহীন
তোমাকেই বার বার রক্ষাকর্তা মানি—
এ’তো আমাদেরই প্রাপ্য, তোমার প্রণামী।
তুমি তারবার্তা পাঠাও, আমরা আমাদের চোখের দিকে দ্যাখি।
তুমি বিসংবাদ লিখো, আমরা দলে দলে ছুটি
তুমি মৃত্যু গণনা করো, আমরা আপাতত বেঁচে থাকার আনন্দ খুঁজি।
আমরা জানি না—
তোমাদের ঐশ্বর্য্যের ভেতর আমাদের কত ঘাম জমে আছে
না খেতে পাবার তিক্ত ইতিহাস,
ক্রমাগত ক্ষয়ে যাবার, পুড়ে মরার শ্যাঁওলা প্রাচীন গন্ধ!
আমরা লুটে নিতে জানি না বলে—
তোমরা আমাদের নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করতে পারো
মৃত জীবন নিয়ে আরেকটু বেশিদিন বেঁচে যেতে পারো!
আমাদের মজলুম জীবনে তাই কোনো জাত নেই, ধর্ম নেই
আমাদের আছে তীব্র ভয় আর বেঁচে থাকার তীব্র বিবমিষা!
মড়ক সংবাদ ২
পাখিটির অস্থিরতা ছেড়ে এসো, মুখোমুখি বসি
এখনো তো ফুরায়নি নিঃশ্বাসের অদৃশ্য রেখা
আজকে বিবাদ ভুলি, হই বেদনার প্রতিবেশী
যদিও উঠানে এক শালিকের সাথে হয় দ্যাখা।
আমাদের ঘুম ভাঙে, আমরা ভুলে থাকি সময়—
তারিখ কিঙবা দিন। সরকারি প্রেসনোট থেকে
দ্যাখি মৃত্যুর তালিকা-আমাদের যাবতীয় ভয়,
ও বিসংবাদলিপি তাড়া করছে যেন প্রত্যেকে।
পাখিটিও ঘরে থাকে ,পার করে এ মড়ককাল
ক্ষুধার সঞ্চয় নেই, নেই কোনো নিবিড় আশ্রয়
দুঃস্বপ্নের ভেতর ভাঙে অসংখ্য স্বপ্নডাল
সারাদিন চামড়ার নিচে শেষ চর্বি ঝলসায়!
আমাদের শেষগান, এসো, তারস্বরে গেয়ে উঠি
ইশারাময় দিনের শেষ আলোরেখাটির সাথে—
প্রাচীন অরণ্যগান, হই উৎসারিত রেখাটি
নগরীর নীরবতা ভেঙে , বিপরীত ধারাপাতে।
আমাদের মৃত্যুদিনে,
অনাবাদী ফসলের মাঠ
গণ কবরের মতো যেন সাজে, ফাঁসির চৌকাঠ!
মড়ক সংবাদ ৩
আজ রৌদ্রদগ্ধ দিনে, দ্যাখি পাখির মতোন চোখে
করোনা ভাইরাসের একটানা প্রোটিন সন্ত্রাসে
কোথাও বিরহ থাক দূর, এ’ বিস্মরণের দিনে
একা বাঁচার বিকল সাধ, ভুল-শুদ্ধ গেরস্থালি
থামিয়ে দিয়েছে এক, জীবন-মৃত্যু উৎপাদনে
সকল দুয়ার এঁটে আপন বন্দী জীবন টানি
ওই পাখির মতোই জীবন চেয়েছি আলগোছে
মনের ভেতর পাখি, নিয়ত বেড়েছে প্রাণপনে
এখন শুধু আঁধার আর বুকের ভেতর ভয়
একা থাকার দুঃখ —হাড়-মাংসের যত ক্ষয়
মড়ক সংবাদ ৪
যেনবা ভ্রূণের মাঝে, শুনি পাতায় পাতায় শব্দ
গাঢ় কোন অন্ধকারে ডুবে যাওয়া এ’চরাচরে
একা—শব্দের চেয়েও বেশি কোন এক নীরবতা
ভাঙছে, উল্কার মতো, দূর থেকে খসে পড়া তারা।
কোন পরিণতি নেই, নেই কোনো স্বপ্নের আহ্লাদ
আছে ক্রমাগত ক্ষয়—
জন্ম থেকে মৃত্যু-নিরবধি।
এসময় মনে পড়ে, মেহেরুন সন্ধ্যাবেলা তুমি—
আমার সাথে উড়ছো, পেছনে চলে যাচ্ছে শহর
আমরা ক্রমশ ঢুকে পড়ি, জল ও জঙ্গলে , শূন্যে
সহসা স্মৃতির মাঝে, বিবিধ মাইলেজ ফলকে।
আমাদের বন্দীদিনে, বেঁচে থাকার তীব্র সাহসে
এ’শহরে বাঘবন্দী , পরস্পরের মুখের দিকে ।
মড়ক সংবাদ ৫
গভীর আঁধার থেকে উঠে আসি— ঘুম থেকে জাগরণের মতো
কিছুক্ষণ চুপচাপ শুয়ে থাকি, তোমার দিকে দ্যাখি
কে যেন আমার শরীরে স্থবিরতা ঢুকিয়ে দ্যায়—অন্ধকার থেকে
আলোর উৎসমুখে, যেন এক দীর্ঘ যাত্রা। এ’যাত্রা শেষ হয় না মেহেরুন!
শহরে এখন মোমবাতির আলোর মতো বিচ্ছিন্নতা। চোখ বন্ধ করতেও ভয় হয়।
আমি মুখের দিকে দ্যাখি—সবগুলো একই মুখ
হাসছে, কাসছে—থু করে ছিটিয়ে দ্যায় থু থু। চায়ে চুমুক দ্যায়-ধোঁয়া টানতে টানতে—ঝাঁকুনি দিয়ে ছাই ফেলে।
হোটেল ব্যবসায়ীরা মিটিং করে, বাজার কমিটি মিটিং করে, রাষ্ট্রপক্ষ মিটিং করে, জাতিসংঘ মিটিং করে—
কোথাও নেই একটু স্থিরতা।
আমার কেবল স্থির জলে শুয়ে থাকতে ইচ্ছে হয়।
দীর্ঘ শ্বাস নিই। এইসব পাতা পুড়ে যাওয়া দিনে জলের বড় হাহাকার। আরশোলাদের মতো দিকে দিকে ছুটি।
মানুষের চিৎকার শুনি—খিস্তি-খেউড়—রাজা-উজির মেরে ফেলার গল্প। আমার কেবল শোকের মতো হাসি পায়।
টিভি নিউজ দ্যাখি—বিবিসি, সিএনএন, সরকারি-বেসরকারি চ্যানেল: মাংস পুড়ে যাবার গন্ধ পাই।
গণ কবরের মতো অশ্লীল মনে হয় সবকিছু!
মড়ক সংবাদ ৬
আমাকে পোড়াও তুমি বিলাসের বিল
কুয়াশা জীবন এক আদিবাসী নাম
সকল প্রণতি ঝরে দরোজায় খিল
আমাকে শুকনো রাখে শরীরের কাম
যেখানে নরক নাচে শিবানীর চোখে
মুদ্রায় ঘুমায় ওরা প্রসবের স্বেদে
আগুন ফেরায় গান আচানক শোকে
তোমাকে রাখেনি নদ চিরচেনা রোদে।
মড়ক সংবাদ ৭
মানুষের দিনলিপি থেকে ঝরে পড়ছে সময়—
পাতার মতোন, যেন শুকনো মওসুম এখন
বহুদিনের পুরনো শ্যাঁওলার ভেঁজা গন্ধ, ক্ষয়
নিয়তির কালোরেখা থেকে দূরে আলোর নাচন।
বয়সীরা অপেক্ষায়, সচেতন রোদ থেকে দূরে
শুকনো মোড়ানো ফুল পড়ে থাকে গাছের ছায়ায়
জীবন জড়ানো গান, যেনবা বিস্মৃতির ওপারে
তবুও স্মৃতিরা আসে—পাশে বসে, কেন ডাকে হায়!
এইতো মানুষ জন্ম,একসাথে পাাশাপাশি চলে
বন্যা, খরা, মহামারী অথবা যুদ্ধের নগ্ন থাবা
নতুন শিশুর মুখ কিংবা বয়সের অঞ্চলে
মানুষ দাঁড়াবে পাশে— না হলে তো মানুষ হবে না!
মড়ক সংবাদ ৮
তুমি এই লকডাউনে বোরডাম।শ্রমিক পাড়ায়-
মরছে মানুষ ক্ষুধার জ্বালায়!
রাস্তা ধরে হন্যে হয়ে ঘুরছে মানুষ
তুমি তখন মুখছবিতে আপ করছো ফ্রেশ জুস!
এই শহরে তুমি একটা মজুতমারানি
আমি তোমায় গাল দেবো না চুতমারানি!
তোমার এখন ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না
একলা একা সিনেরিলে গল্পগুজব আর জমে না
কত কত হা-হুতাশ, ভাল্লাগে না ভাল্লাগে না
ত্রাণ শিবিরে হরিলুটের বন্যা হলেও,রাগ করো না
কারণ তোমার ভাতের অভাব আর হবে না
আর হবে না!
কারণ তুমি একটা মজুতমারানি -
ক্লান্ত হলেও, তুমি একটা চুতমারানি!
মড়ক সংবাদ ৯
কী ভাবছো? ভাবনা দেবে পাহারা?
ভিক্ষা চালের লুটের মহোৎসব
আসছি আমি , আসছে পথের তারা
যাবে কোথায়? পাড়ি দেবে? অসম্ভব!
দেখাও তুমি কয়খানা চোখ দেখে
আরো আছে আর্তনাদের সারি
ক’জন যাবে মৃত্যু ভাসছে চোখে
তুমি নিলে আগাম চৌকিদারি।
যার কিছু নেই সেই তো সর্বহারা
মৃত্যু ছাড়া আর কিছু নেই তার
তুমি দাও গুচ্ছ সম্পদ পাহারা
শোনাচ্ছ গান ভণ্ড মানবতার!
শুনতে কি পাও, বাজছে সাইরেন
দেশ সীমানা পাড়ি দিচ্ছে রোগ
অন্ধকারে ছুটছে রাতের ট্রেন
লুটের চালে আটকে থাকে শোক!
স্পর্শ করো, হাত দুখানা দ্যাখো
এর চেয়ে বড় অস্ত্র নেই তো আর
সে হাত দিয়েই লুটেরাদের রুখো
ভেঙে ফেলো রাষ্ট্র নামের বাজার!
মড়ক সংবাদ ১০
একা একা বসে থাকি আমি আর আদিম ঈশ্বর
শোকেসের দিনলিপি মুছে দ্যাখা আপন ও পর
মুছে যায় মুখোশের দিন, ফুরায় জীবন সার
মুখ থেকে মুছে গেলে চোখ পায় নদীর আকার।
আসে দিন, চলে যায়, মড়কের প্রতি মুখোমুখি
পাথরে সে দাগ থাকে, বাসনার মতোই অসুখী
আসে বসন্ত, আসে না নিরুপদ্রব আলোক দিন
আমাদের বেদনারা নিষেধের পারে হয় লীন।
গরাদজুড়ে সেসব না বলা বাক্যের ভীড় বাড়ে
মানুষ গরল হয়, বিবিধ দুঃখ ও আচারে
তাই মানুষ শুনি না, শুনি শুধু আঁধারের ডাক
অদূরে আগুন জ্বলে—তারা সে আগুনে মুক্তি পাক।
ব্যথার কাজল বলে, আমি কেন তবে পরবাসী?
অচেনা প্রহর এলে সকলেই হয় বানভাসী
এসো, বসি পাশাপাশি—বলি কথা প্রগলভ স্বরে
জীবন গিয়েছে চলে: চলে গ্যাছে শুধু অনাদরে।
আমাদের কথা বলি, যে কথা হয়নি বলা আজো
শিলালিপি লিখে রেখো, যেন ফুরায় ভুল সাম্রাজ্য
খুঁজে পাবে একদিন কোন এক প্রত্ন প্রতিবেশী
সভ্যতার প্রতি পর্বে, সাখাওয়াৎ হয়েই আসি।
আমি তো ফুলের নাম, যে নামেই তুমি তাকে ডাকো
অসহ্য বিষাদ দিনে, সাড়া দেবে—যত দূরে থাকো
প্রতিরূপে পাশাপাশি বেদনার ফুল হয়ে ঝরে
মানুষ অথবা ফুল—প্রতিশব্দে বিবিধ আকড়ে।
মানুষের মৃত্যুদিনে মূল্যহীন কাগজের নোটে
লিখে রেখো সবকিছু —এগুলো কাজে লাগেনি মোটে
পথে পথে ছড়িয়েছে মানুষ ও মৃত্যু মহামারী
পৃথিবী পড়তে শেখো, মাটি-বায়ু সকল অশরীরী।
মন্তব্য