বৃষ্টিতে সবচেয়ে বেশী অপূর্ব রূপে ধারণ করে আমাদের ঢাকা শহর। পৃথিবীর অন্য কোনো নগরীতে বৃষ্টি হয়তো এতোটা মাধুর্যতা ছড়ায় না।
নন্দিত কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের দু্ইটি অসম্ভব প্রিয় জিনিস ছিলো, জোছনা এবং বৃষ্টি। বৃষ্টির শব্দ টিনের চালে ঝমঝমাইয়া পড়বে আর সেই শব্দ তিনি উপভোগ করবেন বলে তৈরি করছিলেন 'বৃষ্টি বিলাস' নামের বিশাল আকৃতির বারান্দা সহ একটি টিনের ঘর।
বৃষ্টি শুরু হলেই তিনি মগ ভর্তি চা নিয়ে বৃষ্টি বিলাসে উপস্থিত হতেন। চা হাতে বারান্দায় বসে মাঠের দিকে মায়াবী দৃষ্টিতে তাকিয়ে বৃষ্টি দেখতেন আর ঝমঝম শব্দ শুনতেন। যতক্ষণ বৃষ্টি হতো তিনি বৃষ্টি বিলাস ছাড়া কোথাও যেতেন না।
বৃষ্টি যে চমৎকার উপভোগের একটি জিনিস, বৃষ্টিও যে আয়োজন করে উপভোগ করা যায় সেটা বাঙালির মনের মধ্যে নতুন করে জাগিয়েছেন হুমায়ূন আহমেদ। নুহাশ পল্লীতে এখন আর কেউ এতো আয়োজন করে বৃষ্টি উপভোগ করে না। আহা! কে আর অমন শৈল্পিক বাসনায় বৃষ্টি দেখবে?
পৃথিবীর সবচেয়ে রঙিন নগরী আমাদের ঢাকা শহর। এই কথা আমি শুনেছিলাম সাবেক নেদারল্যান্ড রাষ্ট্রদূতের কাছে। নেদারল্যান্ড রাষ্ট্রদূত যখন তার শিশু বয়সী ছেলেকে নিয়ে ঢাকার রাস্তায় বের হতো তখন তার ছেলে বারবার বলতো, 'বাবা এই শহরটা এতো কালারফুল কেন?'
শহরকে রঙিন করে রাখার জন্য সবচেয়ে বেশী অবদান দিতে হবে রিক্সাকে। যেদিন এই শহরে কোনো রিক্সা থাকবে না সেদিন নিঃসন্দেহে এই শহর তার রঙ হারাবে। রিক্সার মত যানবাহন পৃথিবীর অনেক শহরেই আছে। কিন্তু শহরের বুকে রিক্সা একমাত্র ঢাকা শহরেই চলাচল করে।
পৃথিবীর সবচেয়ে সুমধুর ধ্বনি বেজে উঠে আমাদের ঢাকা শহরে। ভোররাতে ফজরের আজানের মত সুমধুর ধ্বনি আর কিছু হতে পারে না। আমার মনে হয়, একজন মানুষ যদি অন্ধকার ভোরে বেলকুনিতে দাঁড়িয়ে খুব মনোযোগ দিয়ে ফজরের ধ্বনি শোনে তবে তার আত্মা পবিত্রতায় ভরে উঠবে।
শারদীয় উৎসবে ঢাকের বাদ্যযন্ত্রে বেজে উঠা প্রাণবন্ত আওয়াজ পৃথিবীর আর কোথাও নেই। খেয়াল করে দেখবেন ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকলের মাঝে ঢাকের তালের আওয়াজ অদ্ভুত এক উদ্দীপনা সৃষ্টি করে। ঢাকের তালে আওয়াজের আশেপাশে থাকা মানুষগুলোর দিকে তাকে কখনো বিষন্নতা খুঁজে পাবেন না। মনটা সবসময় প্রাণ চঞ্চলতায় ভরা থাকে।
প্রেমে আবদ্ধ দুইজন প্রিয় মানুষকে সবচেয়ে বেশী মুগ্ধতা নিয়ে পথ চলতে দেখা যায় আমার ঢাকা শহরে। এই শহরের প্রেমিক পুরুষ প্রিয়জনের জন্য ঘন্টার পর ঘন্টা রাস্তার জ্যামে সময় নষ্ট করেও ক্লান্ত হয় না। এতো মায়া-মমতা আর আবেগ নিয়ে পৃথিবীর কোথাও প্রেমিকা তার ওড়না দিয়ে প্রিয় মানুষের কপালের ঘাম মুছে দেয় না। রাস্তায় হেঁটে যাওয়া প্রেমে আবদ্ধ দু'জন মানুষের চোখের দিকে তাকালে লাজুকতায় ভরা মায়াবী স্বপ্নে বিভোর দুই জোড়া চোখ শুধু এই শহরের প্রেমেই দেখতে পাবেন।
এই শহরের প্রতিটি উদ্যানে, পার্কে, লেকের আশেপাশে সবসময় কিশোর বয়সী একদল ছেলের দেখা মিলবে। এই কিশোরদের মধ্যে অনেকেই বাবা-মার পরিচয় জানে না, অনেকে এক বেলা ঠিকমত ভাত খেতে পারে না, অনেকে রাতে ঘুমানোর জন্য নির্দিষ্ট কোনো ঠিকানা জানেনা। কিন্তু খেয়াল করে দেখবেন শহরের এই কিশোরদের মাঝে এক ধরণের প্রাণচঞ্চলতা এবং হাসিমুখ দেখা যায়।
গ্রীষ্মের দাবদাহে দুপুর হলেই এই কিশোরের দল জিয়া উদ্যানের ব্রিজ থেকে সৃষ্টি সুখের উল্লাসে লেকের লেকের পানিতে লাফ দেয়। আবার কাঁপুনি লাগা প্রচন্ড শীতের সন্ধ্যায় ধানমন্ডি বত্রিশে একসাথে আগুণ তাপায় আর খুঁনসুটি করে। শহরের এই কিশোরদের জন্য আনন্দের কোনো নির্দিষ্ট সংজ্ঞা নেই।
একমাত্র এই শহরের মানুষজন জীবিকার জন্য কর্ম বাদ দিয়ে ক্রিকেট খেলা উপভোগ করে। টিভিতে যখন খেলা চলে তখন রাস্তার টং এর দোকানের মামা চা বানাতে গেলে চায়ের কাপের চামুচে হাত থেমে যায়। রিক্সাওয়ালা মামা রিক্সা চালানো বাদ দিয়ে নিজেই যাত্রীর আসনে বসে যায়। অফিস শেষ করা ক্লান্ত মানুষজন বাসায় ফেরার পরিবর্তে রাস্তায় দাঁড়িয়ে খেলা দেখে। স্কুল-কলেজ পড়ুয়া ছেলেরা ক্লাস ফাঁকি দিয়ে স্কুল-কলেজ পালিয়ে খেলা দেখতে বসে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলে-মেয়েরা নিজেরাই অঘোষিত ক্লাস ক্যান্সেল করে দিয়ে একসাথে খেলা দেখতে বসে।
সাকিব ছক্কা হাঁকালে একদম বয়স্ক দূর্বল মানুষটাও সকলের সাথে গগনবিদারী চিৎকার দিয়ে উঠে। আবার আউট হয়ে গেলে হতাশার নীরব ধ্বনির আওয়াজে একসাথে সবাই মাথার চুল হাতানো শুরু করে দেয়। কারণ বাংলাদেশ জিতে গেলে সেদিন রিক্সাওয়ালা মামার রাতে না খেলেও চলবে। তবু জয় চাই!
এই ছোট্ট ঢাকা শহরের কোথাও গেলে মনে হবে বড্ড যান্ত্রিক জীবন, আবার অন্য কোথাও গেলে মনে হবে প্রাণবন্ত জীবন। কোথাও যান্ত্রিক শব্দের কোলাহলে মিশে আছে পথ-ঘাট। কোথাও একদম নীরব শান্ত পরিবেশ। আবার বড়বড় দালান কোঠার শহরের মাঝে কোথায় গেলে মনে হবে মফস্বল এতো এলাকার জীবনের মত। এই শহরে প্রথম কেউ মধ্যরাতে আসলে বুঝতেই পারবে না দিনের বেলা শহরটার চেহারা কেমন হবে।
পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশী স্বপ্ন-বিলাসী চোখ খুঁজে পাওয়া যাবে আমার ঢাকা শহরে। স্বপ্নের বাস্তবিকতা থাকুক আর না থাকুক, স্বপ্ন কখনো পূরণ হোক আর হোক। তাতে এই শহরের মানুষ কখনো স্বপ্ন-বিলাসী হতে ভুল করে না। শহরের প্রতিটি মানুষের চোখের দিকে তাকালে মনে হবে অদ্ভুত কৌতুহল আর গভীর চিন্তায় নিমগ্ন।
একমাত্র ঢাকা শহরে মধ্যরাতে দেখা মেলে ঘুমহীন বিশ্বস্ত কুকুরের চোখ। এই শহরের প্রতিটি রাস্তার মোড়ে মধ্যরাতে খুঁজে পাওয়া যায় অসহায় নারীর ভয় কাতর চোখ। এই শহরের সবচেয়ে গরীব মানুষটি সাহায্য চাওয়ার জন্য সবচেয়ে ধনী মানুষটির গাড়ির জানালার গ্লাসে টোকা দিয়ে মিনতি জানায়। কি অদ্ভুত!
পৃথিবীর সবচেয়ে বৈচিত্রময় নগরী আমার ঢাকা শহর। শহরের পাঁচ তারকা হোটেলে যেমন মানুষ ঘুমায় ঠিক তেমনি রাস্তার ফুটপাতে মানুষজন শান্তিতে ঘুমিয়ে রাত কাটিয়ে দেয়। কেউ রাতের বেলা শহরের সবচেয়ে দামী খাবার খেয়ে ঢেকুর তোলে অন্যদিকে কেউ সারাদিন অনাহারে থেকে ঘুমানোর জন্য বারবার হাই তোলে। অথচ কোথাও কারো কোনো অভিযোগ নেই। কখনো কি দেখেছেন, এই শহরের অসহায় মানুষগুলো অন্নের জন্য, বাসস্থানের জন্য আন্দোলন কিংবা প্রতিবাদ করতে?
এতোসব অনন্য বৈশিষ্ট্য থাকার সত্ত্বেও ৪০০ বছরের পুরোনো ঢাকা শহরের সমস্যা, জটিলতা, অসুবিধার কোনো শেষ নেই। তবু দিন শেষে আমরা সবকিছু ভুলে গিয়ে এই শহরের নিশীথে ঘুমিয়ে যাই। আবার পরের দিন সকালে নানারকম আক্ষেপ আর হতাশা নিয়ে দিন শুরু করি। তবু কোন একটা বিশেষ কারণে এই ঢাকা শহরের মায়া ত্যাগ করতে পারি না।
কেন জানেন?
কারণ এই শহর প্রাণের শহর। এই শহর মানুষের সাথে জাদু¹ করতে জানে। নইলে তথাকথিত বসবাসের দ্বিতীয় অযোগ্য শহর ঢাকায় কোনো যোগ্য মানুষ আর বসবাস করতো না।
পৃথিবীর এই অসুস্থতায় বড্ড মিস করছি সেই চিরচেনা ঢাকা শহরকে। যে শহরে মানুষ ব্যস্ত হয়ে ছুটে চলে জীবন তাগিদের নেশায় কিংবা সৃষ্টি সুখের প্রাণের উল্লাসে। তুমি সুস্থ্য থেকো প্রিয় ঢাকা। প্রাণের কোলাহলে আবার আমরা মাতিয়ে তুলবো তোমার চিরচেনা সেই রূপে আর ঘ্রাণে।
¹পাদটীকাঃ ১৬৩০ সালে জুলাই মাসে,মুঘল সম্রাট শাহজাহান আগ্রা থেকে ঢাকায় ভ্রমণে এসেছিলেন। তিনি মূলত ঢাকায় এসেছিলেন 'মসলিন' শাড়ি ক্রয় করার জন্য। তিনি তার স্ত্রী মুমতাজকে ঢাকার বিখ্যাত 'মসলিন' উপহার দিতে চেয়েছিলেন।
সুবেদার মীর জুমলা তখন বাংলা তথা ঢাকার অধিপতি ছিলেন। মীর জুমলা সম্রাট শাহজাহানের জন্য বুড়িগঙ্গার পারে সুবেদার দূর্গে আতিথেয়তার ব্যবস্থা করেন। আর ঢাকা শহর ঘুরে দেখার জন্য একটি হাতি এবং দুইটি ঘোড়ার ব্যবস্থা করেন।
শ্রাবণের শুরুতে ভরা বুড়িগঙ্গা নদীর পানি আর বর্ষার মাধুর্য মিশ্রিত ঢাকা শহর দেখে সম্রাট শাহজাহান এই শহরকে ''জাদুর শহর ঢাকা'' তকমায় ভূষিত করেছিলেন।
আমাদের এক টুকরো নগরী ঢাকা...
মন্তব্য