রেলক্রসিং দিয়ে পাড় হচ্ছে রিকশা। ক্লান্ত, শ্রান্ত রিকশাওয়ালা সিট থেকে নামলেন। রিকশা টেনে তুলছেন।
জিজ্ঞাসা করলাম, মামা কষ্ট হয়?
সে বলল, না মামা। বেশি কষ্ট না। রোজা তো রাখি নাই।
রোজা কেন রাখেন নাই, জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছে হলো না। তার শরীর দিয়ে ঘাম ঝড়ছে। কোমরের কাছে বাঁধা গামছা দিয়ে একটু আগে সে মাথা মুছেছে। তার গেঞ্জি ভেজা। পিঠের বসন্তের দাগ দেখা যায়।
অনবরত ঘামছি আমিও। সকাল থেকে এখন পর্যন্ত শার্ট ভিজেছে দুই বার। গায়ের ঘাম গায়ে শুকাচ্ছে। এই রোদে হুড তুলে দেয়া রিকশায় খুব বেশি বাতাস আসছে না।
তবুও রোজা রেখে আমার যতটা না কষ্ট হচ্ছে তারচেয়েও বেশি ক্লান্ত দেখাচ্ছে রিকশাওয়ালাকে।
আবার কথা বলা শুরু করলাম,
- চাচা, আপনার মনে হয় বেশি কষ্ট হচ্ছে। রিকশা থামিয়ে একটু জিরিয়ে নেন।
- না, বাজান। আসলে পানির তিয়াশ লাগছে খুব।
- তাহলে একটা টঙ দেখে রিকশা থামান।
রিকশাওয়ালা একটা টঙের সামনে সাইড করালো রিকশা। পর্দা দেয়া টঙে দূর থেকে পর্দার নিচে দিয়ে শুধু স্যান্ডেল, প্যান্ট আর লুঙ্গি দেখা যায়।
রিকশা থেকে থেকে নামলাম, রিকশাওয়ালাও নামলেন। দুই গ্লাস ফিল্টার পানি ঢক ঢক করে খেলো সে।
- চাচা, সিগারেট খাবেন?
- হ খামু।
- কী সিগারেট খান?
রিকশাওয়ালাদের এই প্রশ্ন করা মানে এক ধরণের বিপদে ফেলা। আবার এক ধরণের পরীক্ষাও। এভাবে সিগারেট খাওয়ার সুযোগ আমি বেশ কয়েকজনকে দিয়েছি। এ প্রশ্নটা করে, আগ্রহ নিয়ে উত্তর শুনি। কেউ বেনসন খেতে চায় কিনা এটা দেখার জন্য। তবে এখন পর্যন্ত কেউ চায় নি।
রিকশাওয়ালা বললেন, বাবা আমি পাইলট খাই।
আমি বললাম, একটা বেনসন ধরান। তিনি ধরালেন না। দোকান থেকে পাইলট নিয়ে ধরালেন। সিগারেটের ব্র্যা ন্ড একটা বড় ব্যাপার সবার কাছেই। নিজের ব্র্যা ন্ড ছাড়া কেউ অন্য কিছু খায় না।
- আর কিছু খাবেন চাচা?
- না, থাউক। চলেন আপনার দেরি হয়া যাইতাছে।
- আমার অত তাড়া নেই। আপনি ভাত খেয়েছেন?
- সকালে খাইছি। শেষ রাইতের ভাত তরকারি সকালে বউ গরম কইরা দিছে।
- দুপুরে ভাত খাবেন না?
- না, আল্লাহ দিলে, একবারে ইফতার করমু।
- তাহলে তো রোজাই রাখতে পারতেন। সারাদিন তো প্রায় না খেয়েই থাকছেন।
রিকশাওয়ালা কিছুক্ষণ দম নিলেন যেন। তারপর আহত হতাশার সাথে কিছুটা গৌরব মিশিয়ে একটা নিষ্প্রভ হাসি দিয়ে বললেন,
- বাবা শোনেন। আগে একবেলা রিকশা চালাইতাম। একবেলার টাকা দিয়াই সংসার মোটামুটি চলতো। রোজার সময় সবকিছুর দাম বাইড়া যায়। আমার ছুডু মাইয়াডা ক্লাস থ্রিতে পড়ে। একটা রোজাও ভাঙ্গে না। মাইয়া আমার ইফতারিতে বেগুনি খাইতে চায়, জিলাপি খাইতে চায়, ট্যাং খাইতে চায়, ফল ফলাদি খাইতে চায়। তার ফর্দের অভাব নাই। রোজা থাকে বইলা এইসব না কিনা নিয়া বাসায় গেলে মনডা খচখচ করে। রাইতে ঘুম আসে না। এইসবের তো মেলা দাম। সেই বাড়তি টাকা জোগাড় করার লেইগা রোজার দিনে দুই বেলা রিকশা চালাই। বউডাও অসুস্থ, রোজার মাসে কাম করতে পারে না। এক হাতের কামাই তো, বেশি না করতে পারলে এই মাসে বাইচ্চা থাকতে পারুম না।
- তাই বলে সারাদিন এভাবে না খেয়ে থাকবেন?
- আমার মাইয়াডা ইফতার করার পর যে খুশিডা হয়! সারাদিন সেই কথা মনে হইলে আমার আর খিদা লাগে না। তয় মানুষের পেট তো, পেট অত পিরিত বোঝে না। মাঝেমধ্যে একটা বন রুটি খায়া ফেলাই। তয় বাবা, রোজা রাখতে পারতাছিনা বইলা খুব খারাপ লাগে নিজের কাছেই। সারাদিন না খায়া থাকলেও আমার কোনো সমস্যা নাই। তয় এই রোইদে পানি না খায়া রিকশা চালাইতে পারি না। গলাডা কাঠ হয়া যায়। তাই রোজা রাখতে পারি না। আমার আল্লায় আমারে মাফ করলে হয়!
রিকশাওয়ালা আর কথা বাড়ালেন না। আমার তাড়া না থাকলেও তার পরের ট্রিপ ধরার তাড়া আছে। আমাকে রিকশায় উঠিয়ে তিনি প্যাডেল মারা শুরু করলেন। টঙ দোকানটা ধীরে ধীরে দৃষ্টির সীমানার বাইরে চলে যাচ্ছে। আবছা আবছা পর্দার নিচে দিয়ে দেখা যাচ্ছে, দুই জোড়া প্যান্ট পরা পা, একটা লুঙ্গি। যেখানে জমে আছে অসংখ্য "আল্লায় আমারে মাফ করলে হয়" টাইপের গল্প।
প্রতিটি মানুষই এমন। এক লাইন শুনে কিংবা একবার দেখে কখনোই কোন মানুষকে ব্যাখ্যা করা যায় না। মানুষকে জানতে হলে, তার পুরো গল্প শুনতে হয়। একেকজন মানুষ যেন একেকটা হাজার পৃষ্ঠার গল্প...
মন্তব্য