চূড়ান্ত পাগল হয়ে ওঠা
আমি সারা-দিন-রাত ঘুমাইছি। ঘুম ভাঙার পর দেখি মা বিষণ্ণ পৃথিবীর মুখ। বোনদের আর্তনাদে ‘বাবা নিরুদ্দেশ’। আমি বিছানা ছেড়ে উঠে সবাইকে বুঝাই— আমার বাবা নিরুদ্দেশ না, আমার বাবাকে নিরানন্দ দাশ খুন করেছে। আমার সমুখে। কেউ বিশ্বাস করেনি আমার কথা। সবাই আমারে শান্ত হতে বলে। বলে আরো কিছুটা সময় ঘুমাতে। অথচ আমার ঘুমের আফিম কর্পুরের মতো উড়ে গেছে নিরুদ্দেশে। আমি ফের ফিরে যাই শিশুবেলায়। হাউমাউ করে কেঁদে উঠি। ঘর থেকে বের হয়ে আসি। কদ্দুর যাওয়ার পর, গ্রামের বাচ্চাগুলা আমাকে ঢিল ছুঁড়ে মারে। আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করে।
বন্ধুদের ডাক দিলেও না শুনার ভান করে চলে যাচ্ছে যেন আমি এক প্রেতাত্মা। বড়রা বলছে আফসোস করে করে, আমাগো গেরামে সেই পুরনো নষ্ট ছায়া, ফিরেছে নিরানন্দ দাশ। নিজজন্মদাতাকে খুন করে ঘুরছে কেমন বীরবেশে রাস্তায়। শালার তো মরে যাওয়া উচিৎ। আমি দৌড়ে গিয়ে সেই ঝুপের সামনে দাঁড়াই। নিরানন্দ, নিরানন্দ বলে চিৎকার করি। কিন্তু কেউ বের হয়ে আসেনা। আমি ভুলে গেছি, আমার তো কোন বন্ধু নেই নিরানন্দ দাশের মতো, এই নামে। আমি ডাকলে কে-ই বা আসবে? আমি জ্বালিয়ে দিই সেই ঝোপ। দাঊ দাঊ আগুনে জ্বলে পুড়ে রাগ হয়ে যাচ্ছে আমার দেখা পৃথিবীর শেষ দেবদূতের বাসস্থান। আমার ভিতরে বাজছে বাবার সেই কথা, নিরানন্দ, বন্ধু আমার, আমাকে ক্ষমা কর। আমার ঘরই কেন পছন্দ করলি তোর পুনঃজন্মের? কেন আমার বউ এর গর্ভই ভেবেছিস নিরাপদ আশ্রয় তোর দ্বিতীয় জন্মের?
পাগলাগারদে যাত্রা
বিন্দু bindumag.com
যেখানে দ্যাখা নিরানন্দ দাশের সাথে। খাওয়া দাওয়া ছেড়ে ঐখানে ঘুমাইছিলাম। ঘুম থেকে জাগায় আমার ছোট বোন। মুস্তাবশিরা। সে খাবার নিয়ে এসে প্রতিদিন রেখে যেতো। আমাকে ডাকলেও উঠতাম না। ঐ খাবার সব পঁচে দুর্গন্ধ। এমন দুর্গন্ধের ভিতরে আর কেউ আসতো না। সবাই ভাবতো, আমি মরে গেছি। শুধু আমার ছোট্টবোনটা বিশ্বাস করতো আমি মরিনি। বেঁচে আছি। যেদিন আমি জেগে উঠি সেইদিম ও পাশে বসে কাঁদছিলো। তার চোখের জল আমার প্রাণকে কেমন একটা শান্ত আবহ দিয়ে দোলা দেয়। সে আমাকে জড়াই ধরে খুব জোরে কাঁদতে থাকে। সে কাঁদতে কাঁদতে বলে, মা মরে গেছে। বাসায় আর কেউ নাই। বড়দি মারা গেছে সেই চার সপ্তাহ। দাদা, আমার ঘরে একলা থাকতে খুব ভয় করে। তুই ঘরে চলে আয়। আমি নিরুত্তর। পাথরের মতো। শুধু তাকিয়ে আছি। ও আমারে ধরে যেই লোকালয়ে আসে, মানুশগুলো নাক সিঁটকাতে থাকে। ঢিল ছুঁড়তে থাকে। আমাকে বাঁচাতে গিয়ে বোনের কপাল থেকে রক্ত ঝরে৷ আহা! ফুল আমার। রক্তজবার মতো লাগছে তোরে। বোন হো হো করে হেসে দেয়। মানুষগুলা আমার বোনরে টেনে নিয়ে যায়। ঘরে ডুকিয়ে দিয়ে বাইরে থেকে তালা বন্ধ করে দেয়। আমাকে ধরে নিয়ে যায় পাগলা গারদে। বিন্দু bindumag.com
পাগলাগারদের দিনগুলি
বিন্দু bindumag.com
এখানেই প্রকৃত মানুষ দেখি। প্রকৃত হাসি দেখি। দেখি প্রকৃত কান্না। কোন মুখোশ নাই। আমার নিজেকে মানুষ ভাবতে সুবিধা হয়। একা থাকি। শক দিতে নিয়ে গেলে যাই। শক খেয়ে চিল্লায়। শক শেষে মৃত্যু-পরবর্তী সময়ের মতো চুপচাপ ফ্লোরে শুয়ে থাকি। নার্স আসে। শাদা কাঁপড় পরে, যেন হুর। যেন পরী। তারা ওসুধ দিলে খাই। ওসুধগুলা খুব মজার। স্বাদও দারুন। সিগারেট নিষেধ। দীর্ঘ দুই মাস পর আমাকে দেখতে আসে বোন। আমি চুপচাপ থাকি। বোন কথা বলতে চায়। আমি বলি না। সে কাঁদে। আমি আঁখিজল মুছে দিই না। সে রাগ করে বলে, মায়ের মতো, বোনের মতো আমিও মরে যাবো। তুই কথা না বল্লে। আমি নিরাবেগ রই, তাকিয়ে থাকি দূরে একটা নার্সের দিকে। নার্স মানে শাদা কবুতর। এই পাগলাগারদে তারা স্বাচ্ছন্দ্যে উড়াউড়ি করে। ডানা ঝাপটায়। ডাক্তারের রুমে যায়? যায় না। সেদিন একটা নার্স সাত তলা উপর থেকে লাফ দিয়ে মরে গেছিলো। ঐটাও তো খুন। কে জানি তার কাপড় টেনে ছিঁড়ে ফেলতে চেয়েছিলো। সে পুরুষ কি ডাক্তার? নাকি তার সহকর্মী? নাকি অন্যকোন নিম্নপদস্থ কর্মচারী? কেউ তার পরিচয় জানে না। অথচ দায়িত্বটা আমাকে দিলেই পারতো। আমি তো পশু চিনি। মানুষ আর পশুকে একসাথে রাখলেও আমি পশুকে আলাদা করতে পারি। মনে মনে বিড়বিড় করতেছি। হঠাৎ কাঁধের উপর থেকে সরে যাচ্ছে পরিচিত শান্তির স্পর্শ। ফিরে তাকাই। বোন চলে যাচ্ছে। তার সময় শেষ। ভাই এর সাথে দেখা করতে আসলেও এরা সময় বেঁধে দেয়। খুব লজ্জার কথা। আমি ডাক দিই, মোস্তাবশিরা। ও দৌঁড়ে চলে আসে। হাসতে হাসতে কাঁদতে কাঁদতে আমাকে জড়াই ধরে বলে, ভাই, তুই ডেকেছিস? তুই কথা বলেছিস আমার সাথে? সোনাভাই আমার। সে ডাক্তার, নার্স সবাইকে চিৎকার দিয়ে ডাকে। সবাই জড়ো হলে বলে, ভাই আমার আমাকে নাম ধরে ডেকেছে। আমার ভাই ভালো হয়ে গেছে। আমার ভাইকে ছেড়ে দিন। আমি ঘরে নিয়ে যাবো। ডাক্তার বলে উঠে, না না, এটাই উনার উপযুক্ত জায়গা। মাত্রই তো সুস্থ হওয়া শুরু করেছে। আমরা ট্রিটমেন্ট করি। পুরোপুরি সুস্থ হলে আমরা নিয়ে যেতে দিবো। আপনি এখন আসতে পারেন বলে সবাই যার যার কাজে। আমি অন্যদিকে তাকিয়ে আছি। আমার ভালো লাগে ঐ নার্সটা। যে আমার বোনের উল্লসিত আওয়াজকে ধরে এখানে ড্রামা দেখতে আসেনি, হাসতে আসেনি মুখে হাত দিয়ে। সে নিজের কাজে মনোযোগী। সে জানে, এখানে এভাবে কখনো কোন রোগী ছাড়েনা ডাক্তাররা। সে জানে, এইসব উৎসবের রঙ যেই দিক দিয়ে বের হয়ে আসে ডাক্তাররা সেইদিকে ঢুকিয়ে দেয়। আমার ভালো লাগে ঐ নীরবে সত্য বলা শাদা পায়রাবতটারে। বোনকে বলি, আমি এখানেই থাকবো। মানুষের ভিড়ে৷ পশুদের জেলখানায় আমি যাবো না। পারলে দেখতে আসিস। নতুবা তুই এখানে এসে ভর্তি হয়ে যা পাগলের ভান ধরে। বোন হেসে দেয়। বিন্দু bindumag.com
কারাগারে
বিন্দু bindumag.com
একদিন ফ্লোরে শুয়েছিলাম। বাইরে প্রচণ্ড বৃষ্টি। নক্ষত্রপতনের শব্দে পুরো পরিবেশ কেমন অদ্ভূত রূপ নিয়ে প্রতিভাত হচ্ছে আমার উপর। বিন্দু bindumag.com
হঠাৎ রুমে ডুকে নার্স। ঢুকেই দরোজা বন্ধ করে দেয়। সে অনেকটা ভিজে গেছে। আমি এমন সুন্দর স্নাত রমনী কখনো দেখেছি আগে? হয়তো না। এসে সোজা আমার পাশে বসে৷ চোখে উচ্ছাস। ঠোঁটে সাতরাচ্ছে রাজহাঁস। আমি তাকিয়ে আছি। সে প্রথমে বললো, আপনার বোনের সাথে কথা হয়েছিলো। তিনি জানালেন, আপনি একজন কবি। আমার আজন্ম সাধ একজন কবির সাথে বসে সারা রাত গল্প করবো। আপনি আমার সাথে গল্প করবেন? আমি ফ্লোরে চোখ নামিয়ে আনি। চুপচাপ। ভিতরে এতোটা প্রবল ঝড়, বাইরের দুনিয়া তুলপাড় করে দিবে, পৃথিবীর কোন চিহ্নই থাকবে না এই ঝড়কে বের হতে দিলে। সে আমার কাপালে হাত রেখে বলে, 'আপনার তো প্রচণ্ড জ্বর'। আমি বলি, না, আমি ঠিক আছি। কোন জ্বর নেই। দয়া করে আপনি বের হয়ে যান। একা থাকতে দেন আমাকে। সে জেদ নিয়ে বলে, না যাবো না। সে গলার পাশ দিয়ে কামিজের ভিতরে হাত ঢুকাচ্ছে। এই দৃশ্য দেখে আমি খুব ভয় পেয়ে যাই। কাঁপতে থাকে শরীর। সে হাত বের করে আনে, একটা মখমলের মতো শাদা কাগজ। তার নার্সীয় ড্রেসের মতো, হয়তো তার হৃদয়ের মতো। সে বের করে এনে বলে, এইটা আপনার কবিতা? আমি ছুঁ মেরে নিয়ে দেখি লেখা—
'তনু এবং একটি শুয়োরের-বাচ্চা-রাষ্ট্র/ নিরানন্দ দাশ
বিন্দু bindumag.com
ও আমার শুয়োরের বাচ্চার রাষ্ট্র
তুমি ছিঁড়েছো ফুল হায়েনার মতো
মেলেছো ডানা যেন রাঙা ডাইনোসর
বোনের স্তনে রেখেছো নগ্ন নষ্ট হাত
এসো; এই উদ্বাস্তু শিবিরে আমি
লিখেছি তোমার মৃত্যু; এই কলম জুরে শিশ্নের হাহাকার
ও আমার বন্যশুয়োরের রাষ্ট্র
এসো, আমি তোমার মজ্জায় লিখেছি ধ্বংস
বোনের ত্রিবেণী ছিঁড়া রক্তে।
বিন্দু bindumag.com
তুমি আমার ভাইয়ের শার্টে দিয়েছো লাল
বনেদী রঙ— সবুজ গিয়েছে ছিঁড়ে
তুমি আমার মায়ের শাড়ী খুলে দিয়েছো সান
বন্য শূয়রের নলে— আদালতে নিলাম করেছো সিনে
বিন্দু bindumag.com
আসো, আসো হে হয়েনা রাষ্ট্র; ঘৃণে
তোমার মুণ্ডু ধোয়াবো আগুন রক্তে'
বিন্দু bindumag.com
আমি কাগজটা ছিঁড়ে উড়িয়ে দিই। সে আমার গালে চড় মারে। আপনি এখানে কেন? আপনি এখানে থাকার কথা না। পালিয়ে যান। আমি সাহায্য করবো। এই পৃথিবী আপনার, এই পৃথিবীর দুঃখের অশ্রু আপনি। কবি, আপনি বন্দী মানে, এ জল্লাদখানায় মরে যাচ্ছে দুনিয়া। আপনি পালিয়ে যান, হে নিরানন্দ।
বিন্দু bindumag.com
এই প্রথম ভেতরে শব্দ শুনি ডানা ঝাপটানোর। বাবার, নিরানন্দ দাশের। তারা অনবরত ঝাপটাচ্ছে ডানা আমার ভিতর। এই প্রথম কোন রমনীর ঠোঁটে আমার লিখতে ইচ্ছে করছে আমরত্ব। আঁকতে ইচ্ছে করছে দণ্ডীত গন্দম ফল। আমি এগুনোর আগেই সে আমার ঠোঁটে এঁকে দিতে থাকে পৃথিবীর সমস্ত ঝর্ণার উচ্ছ্বাস ও স্নিগ্ধ আগুন।
বিন্দু bindumag.com
হঠাৎ বিকট শব্দে কে যেনো ভেঙে ফেলে দরোজা। ভিতরে ডুকতে থাকে বুট পায়ে পুলিশ, ডাক্তার৷ শাদা কবুতর আর আমি অমৃতরসে ডুবে যাচ্ছে। এখানে ভয়কে বলেছি বিদায়। শূন্যে মেলেছি ডানা। রক্তে দিয়েছি বিদ্যুতের প্রাণ।
বিন্দু bindumag.com
পুলিশ আমাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। গত মাসে মরে যাওয়া নার্স আমারই কারণে সুইসাইড করেছে এমনটাই তাদের ধারণা। এই নার্সকেও আমি গুলাচ্ছি জলে। আমাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ।
ডাক্তাররা যত্নে ধরছে পায়রাবতের বুক। রক্ষার নামে করছে ভোগ?
পায়রাবত আমার, চিৎকার দিয়ে উঠে— হে পুলিশ, ওহে বাঞ্চোদের দল, যার ঘাড়ে রেখেছিস হাত, সেই তো দেশ, সেই তো কবি, নিরানন্দ দাশ। বুলেটের গায়ে করেছে ফুলের চাষ। ওহে পুলিশ, ও রাষ্ট্রের পোষা ঘেউ, হাত রাখিস তার পায়ে, তার কাছে যেতে খুলে রাখিস বুটের অহংকার। নিয়ে আসবি শরীরভর্তি হাসনুহেনার ঘ্রাণ।
বিন্দু bindumag.com
গুলির শব্দে ভেঙে গেছে পায়রাবতের কারাগার। সে উড়ে যাচ্ছে দূরে
আমাকে ছেড়ে— বাবার মতো— নিরানন্দ দাশের মতো— আমাকে ফের ডুবিয়ে দিচ্ছে জেলের গরলে।
খুব ভাল লাগলো
উত্তরমুছুন