১
কয়েকদিন আগে কবিপত্র সম্মান দেওয়া হল বিনয় মজুমদারকে। মৌলালি যুবকেন্দ্রে। উদ্যোক্তাদের অন্যতম বিশিষ্ট গল্পলেখক উদয় ভাদুড়ি। উদয় আমাকে ফোনে জানাল, ঘুঘু এবার ধরা পড়েছে। বিনয় এবার আসছে ঠিকই। লোক গেছে। বোঝাচ্ছে ওকে। তা-ছাড়া ডিস্ট্রিক্ট অ্যাডমিনিস্ট্রেশনকে বলা হয়েছে, ডি-এম, এস-পি, এস ডি ও সবাই জানে। সকালে গাড়িও চলে গেছে, ওকে আনতে।
বিন্দু
জানতাম, আসবে না।
বিন্দু
এই তো সেদিন, ডিভিসি'র সুধীন্দ্রনাথ দত্ত পুরস্কার দেওয়া হল ওকে। আসেনি। চিঠি লিখেছিল: অনুগ্রহ করে টাকাটা (১০,০০০) ড্রাফ্ট-এ পাঠাবেন। চেক নয়। ক্যাশ তো নয়ই।
বিন্দু
অগত্যা ঠাকুরনগরে, ঐ পুরস্কার দিতে যায় স্বয়ং সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। দিয়ে এসে বলেছিল, 'চমৎকার, যথাযথ, টু-দা-পয়েন্ট কথাবার্তা বলল আগাগোড়া। ড্রাফ্টও যত্ন করে রাখল। শুধু—'
বিন্দু
'শুধু?'
বিন্দু
'শুধু ঐ বক্তৃতা করার সময় ঝাড়া আধঘন্টা বিড়বিড় করে কী যে বলল, তার একটি বর্ণও কেউ বুঝতে পারল না।'
বিন্দু
২
আমি কিন্তু পারি বুঝতে। রাবণের মুখ অনেকগুলো। কিন্তু, মাথা ধরত একটারই। জেগে থাকত, ঘুমতে পারত, এবং স্বপ্নও দেখত সে-ই। বাকিগুলো ছিল মুখোশ। যদিও দশাননের কেন্দ্রীয় মুখটিই যে মস্তিষ্কসম্পন্ন, তা জোর দিয়ে বলা যায় না। যে-কোনোটি হতে পারে।
বিন্দু
খ্যাতি যেমন। মুখ তো অনেক। একটি হল জনপ্রিয়তা। মুখ কি? নাকি, মুখোশ?
বিন্দু
লাল-লাল হোটোপে গোরি কিসকা নাম হ্যায়। তোমার লাল-লাল ঠোঁটে, ওগো মেয়ে, বলো কার নাম? মেয়ে (ঠোঁটে আঙুল বুলিয়ে): এই লাল-লাল ঠোঁটে, ওগো ছেলে, এখানে তোমারই নাম। গান একটি। জনপ্রিয়তার উইঢিবিগুলোর মধ্যেও একটা করে এভারেস্ট থাকে যা নাকি সর্বোচ্চ। তারই শিখরে গানটি তা সালভর তো ছিলই। ১৯৭২-এ জর্জ সিমেনন ও '৮১-তে হ্যারল্ড রবিন্স-এর বিক্রির স্ট্যাটাস ছিল যথাক্রমে ৭ ও ১০ কোটি। (কলকাতার প্রকাশকরা তো বিক্রি-বাটার ব্যাপারটা গুহ্যস্থান মনে ক'রে সবসময় লুকোয়। তাই বিদেশের দ্বারস্থ হতে হল।)
বিন্দু
জনপ্রিয়তা? হ্যাঁ। কিন্তু খ্যাতি? না।
বিন্দু
কারণ খ্যাতির মুখ একটাই। আর সেটা হল মরণোত্তর যা—যেটুকু—সেই খ্যাতি। তাম্রপত্র থেকে আম্র পুরস্কার তো কতই। কিন্তু, সে-সবই সেই বাকি নটি মাথার মত। একটিতেও মস্তিষ্ক নেই। তাই, আসল মাথার একটুও মাথাব্যথা দিয়ে বাকিগুলো নিয়ে।
বিন্দু
মরণোত্তর খ্যাতির মত কোনো পুরস্কার নেই। মৃত্যু-পর খ্যাতি শ্রেষ্ঠ পুরস্কার এইজন্যে যে, এই খ্যাতি কোনো মালের উপর কখনোই বর্ষিত হয়না। পরন্তু, এ থেকে উপকৃত হল শুধু মৃত লেখক। পুরোপুরি অবাণিজ্যিক, লেখকের পক্ষে সর্বতোভাবে অলাভজনক এই মৃত্যু-পর খ্যাতি— জীবিত লেখকের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক-ই নেই।
বিন্দু
এই তার পুরস্কার। এ শুধু মৃত যে, তার জন্য। মৃত গায়ক, মৃত শিল্পী, মৃত লেখক, মৃত কবির জন্য। এই মরণোত্তর খ্যাতি। এর নিঃশর্ত আলিঙ্গনে সময় কত অবিসংবাদীভাবে স্বেচ্ছারঙ্গী হয়, তা বোঝা যাবে আমির খাঁ কি বেটোফেনের গানে, কাফকা বা জীবনানন্দের পাথর ভেঙে চুরমার বেরিয়ে আসায়— নাক ভাঙা স্ফিংস মূর্তি যেন সব— রোদে, জলে, কুয়াশায়।
বিন্দু
বিনয় মজুমদারকেও পুরস্কার দেওয়া হয়। কিন্তু কোনোটিতেই সে তো উপস্থিত থাকে না। জীবিত অবস্থাতেই, সে নয়, তার লেখা যেন সেই মরণোত্তর পুরস্কারই পেয়ে চলেছে।
বিন্দু
যদিও সেই কবে ১৯৩৪ সালের পর থেকে গদ্য-পদ্যের এই কবিকে এখনও দেখা যায়। শিয়ালদা থেকে বনগাঁগামী যে-কোনো লোকালে উঠে আজও তাঁর কাছে যাওয়া যায়। ঠাকুরনগর স্টেশন থেকে শিমুলপুর গ্রাম তো পায়ে-হাঁটা পথ। তাঁকে দেখে আসা যায়।
বিন্দু
তো যা বলছিলাম।
বিন্দু
তাঁর দশাননের মধ্যে কোনটি যে আসল (পড়ুন পাগল) সে তো কেউ জানে না।
বিন্দু
মেকানিকাল এঞ্জিনিয়ারিং-এ প্রথম শ্রেণীতে প্রথম (১৯৫৭) বিনয় মজুমদারের মেধার যন্ত্রানুষঙ্গ আজ যাবতীয় মস্তিষ্কচর্চার বাইরে।
বিন্দু
নির্ভুলভাবে তবু, বারবার যা বোঝা যায়, তা হল,
এ-পাগল সে-পাগল নয়।
বিন্দু
সংগ্রহঃ 'তরুণের সাহিত্য জিজ্ঞাসা' (খন্ড ১)/'এই সহস্রধারা'/শংকর রায় সম্পাদিত
একজন বিনয় মজুমদার করে দেখিয়েছেন, পুরস্কারের ছেনালিপনাকে পাশ কাটিয়ে শুধু টেক্সটের জোরে কীভাবে ইতিহাস হওয়া যায়
উত্তরমুছুনবিনয় মজুমদারের কবি-জন্ম। তাই তার কবিতার জন্ম হয়েছে স্বাভাবিক,গাণিতিকভাবে প্রতিভার সহজ ছোঁয়ায়... প্রাত :স্মরনীয় এই কবি।
উত্তরমুছুন