লিখেছেন: সাম্য রাইয়ান
বেকন যখন সরবে ঘোষণা করেন, জ্ঞানই শক্তি (কেননা জ্ঞান ক্ষমতাকেন্দ্রের সাথে যুক্ত) -দ্বিমত করার যুক্তিসঙ্গত কারণ থাকে না। এ কথা তো সত্যি, জ্ঞান নামক হাতিয়ার যার কব্জয়, সে তাকে ব্যবহার করতে চাইবেই। তাহলে কি শক্তিমানের স্বার্থই ন্যায়? (ডায়ালগে সক্রেটিসের বিখ্যাত উক্তি)। প্রাগৈতিহাসিককালেও ব্রাহ্মণরা বেদ নিজের কব্জায় রেখে লোকেদের শাসন করেছে। জোয়ার-ভাটা সম্পর্কে যার সঠিক ধারণা ছিল, সে ইচ্ছে করলেই অন্যদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারতো।
বিন্দু bindumag.com
আজও কি বদলেছে এই অবস্থা? মোটেও না। বুর্জোয়ারা তাদের নানা রকম প্রতিষ্ঠান ও আইন দ্বারা জ্ঞানকে করেছে কুক্ষিগত। জনগণকে জ্ঞান অর্জন থেকে বিরত রেখে তাদেরকে হাজার বছর ধরে শোষণ করাই এর উদ্দেশ্য। এই কর্মকাণ্ডের অংশ হিসেবেই উঠতি বুর্জোয়ারা সংবাদপত্রের নামে এক ধরনের বুর্জোয়া প্রচারপত্রের জন্ম দিয়ে যায়। এই পত্রিকাগুলোর অনেক মুখরোচক শিরোনাম/উপশিরোনাম থাকলেও এসবের আড়ালে এরা বিশেষ রাজনৈতিক দল কিংবা প্রতিষ্ঠানের মুখপত্রের কাজই করে যায়। এই মুখপত্রগুলো মুখরিত থাকে চতুর কিংবা অসচেতন বুদ্ধিজীবীর পদচারণায়। এই প্রতিষ্ঠানগুলো প্রয়োজনমতো লেখক-বুদ্ধিজীবী কিনে রাখে; সময়মতো ব্যবহার ও বিক্রির আশায়। এবং অতি নির্মম-নির্লজ্জভাবে এই রূঢ় বাস্তবতাই ওই লেখক-বুদ্ধিজীবীর সামনে হাজির হয়। এই লেখকগণ প্রতিষ্ঠানের খেদমতে নিজেকে সর্বদাই নিয়োজিত রাখেন। প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন অনুযায়ী শিল্প-সাহিত্য সরবরাহ করাই এদের অন্যতম কাজ। কিন্তু সকলেই কি চায় নিজের স্বাধীনতা বিকিয়ে দিতে? পরাধীনতা আর নির্লজ্জ দালালীর চেয়ে অনাহারে মৃত্যুবরণও যাদের কাছে শ্রেয়, তারাই বিকল্প ভাবনা ভাবতে থাকেন। সেটা হতে পারে কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, মুক্তগদ্য আবার হতে পারে গান, নাচ, চিত্রকলা, চলচ্চিত্র কিংবা অন্য মাধ্যমে।
বিন্দু bindumag.com
২০১০ সালের আগে বাঙলাদেশে উল্লেখযোগ্য যত লেখক তৈরি হয়েছেন প্রায় প্রত্যেকেরই জন্মস্থান লিটল ম্যাগাজিন। অথচ এর পর থেকে এই পরিস্থিতি প্রায় সম্পূর্ণই পাল্টে গেছে! যে লিটল ম্যাগাজিনগুলো একসময় বাঙলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ কবি-লেখক তৈরিতে ভূমিকা রেখেছে, তারুণ্যকে ধারণ করেছে, তার অধিকাংশই সময়ের প্রয়োজনে বন্ধ হয়ে গেলেও আঙুলিমেয় কয়েকটি সাবেকী লিটল ম্যাগাজিন বর্তমানে অপ্রয়োজনীয় বার্ষিক সংকলন প্রকাশ করেই চলেছে। যৌবনের সেই রূপ-রস-গন্ধ তো নেই-ই; নেই বার্ধক্যের প্রজ্ঞাও। আছে শুধুই অশ্লীল দলাদলি; পরস্পর পিঠ চাপড়ানি আর দল বেঁধে অপর লিটল ম্যাগাজিন কিংবা লেখককে আক্রমণ-গালাগালি। অথচ এগুলো পুনরায় শিল্পের কলরবে মুখর হয়ে উঠতে পারতো। কিন্তু হয়নি। এদের সাথে যুক্ত হবার জন্য এখন আর শিল্পচর্চার যোগ্যতা দরকার পড়ে না। এদের কথায় জ্বি হুজুর-জ্বি হুজুর করলেই চলে। ফলে প্রতিভাবান লেখক-শিল্পীদের সাথে এদের আর কোনও ওঠাবসা নাই। এরা নিজেরাই একেকটা অতিক্ষুদ্র মৌলবাদি প্রতিষ্ঠানরূপে বাজারে হাজির রয়েছে। ফলত এইসবে ছাপা হয় নিজেদের অর্থহীন বাগাড়ম্বর, হম্বিতম্বি-গালাগালি আর পুরোনো কিছু মুখস্ত বুলি। যে তরুণরা এখন শিল্পচর্চায় নিবিড়ভাবে যুক্ত, যাদের যুক্ত থাকার কথা ছিল এইসব প্রবীন লিটল ম্যাগাজিনের সাথে, তারা সেখানে নাই। তারা বরং আছেন অন্যত্র - বহিঃপ্রকাশযন্ত্রে। আর একসময় এই লিটল ম্যাগাজিনগুলো যে সার্কেল ধরে ধরে গড়ে উঠেছিলো সেই সার্কেলের মানুষগুলোই ওইসব লিটল ম্যাগাজিনকে প্রতিক্রিয়াশীলতার অভিযোগে বর্জন করেছে। এর পেছনে সবচেয়ে বড় কারণটি হলো, আমাদের এইখানে সম্পাদক মানে একক স্বৈরাচার। যার সামনে সহ-সম্পাদক কিংবা অপরাপর সম্পাদকের কোনও মূল্য নাই। স্বৈরাচার বেশে অন্যের স্বাধীনতা হরণ করে, আর কতদিন একসাথে থাকা যায়? এই বিচ্ছিন্নতাই এই লিটল ম্যাগাজিনগুলোকে পতনের দিকে ধাবিত করেছে।
বিন্দু bindumag.com
পাঠক কি এদের অর্থহীন বাগাড়ম্বর-হম্বিতম্বি আর গালাগালি পড়ার জন্য এগুলো কিনবেন? আর কিনলেও তা কতজন? বাঙলাদেশে পাঠক এইসব লিটল ম্যাগাজিন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন মূলত এদের পতনমূখী প্রবণতার কারণে। লিটল ম্যাগাজিনকে পাঠক তৈরিও করতে হয়। অথচ সাম্প্রতিক সময়ে তা তো হচ্ছেই না বরং ২০০০ এর পর থেকেই তা ক্রমান্বয়ে হারাতে বসেছে, পূর্বের যতটুকু অর্জন। আর এই সময়ে কয়েকটি সাহিত্যপত্রিকা সাহিত্যের বিভিন্ন বিষয় ধরে একেকটি সংখ্যা প্রকাশ, লেখার মান, দর্শন এইসব দিক দিয়ে পাঠক তৈরির কাজটি সুন্দরভাবে করে গেছে।
বিন্দু bindumag.com
প্রতিষ্ঠান/অপ্রতিষ্ঠান, বাজারী/অবাজারী, পণ্য/পণ্যহীন এইসব অভিধার অনেকরকম ভুলভাল (যুক্তিহীন) ব্যাখ্যা হাজির ও প্রচার করে করে ঐ লিটল ম্যাগাজিনগুলো শেষমেশ মানসিকতায় অতি ক্ষুদ্রাকৃতির প্রতিষ্ঠান হয়ে, মৌলবাদি গোষ্ঠীবদ্ধতায় লজ্জাজনক আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠেছে।
বিন্দু bindumag.com
আবারও বলছি, সিরিয়াস পাঠক কেন এইসব কিনবেন? ফাঁকা কলসের দম্ভোক্তি, পরস্পর কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি-গালাগালি আর বানরের তৈলাক্ত গাছে ওঠার কেচ্ছা পাঠের আশায়?
বিন্দু bindumag.com
প্রকৃতপ্রস্তাবে বাংলাদেশে অধিকাংশ প্রবীন লিটল ম্যাগাজিনই মৃত্যুবরণ করেছে। পাঠক, এই বাক্যটি হয়তো আপনি অনেক স্বাভাবিকভাবে পড়ে গেলেন। কিন্তু বিশ্বাস করুন, আক্ষরিক অর্থেই ‘দুঃখভারাক্রান্ত’ মন নিয়ে বাক্যটি রচনা করেছি।
বিন্দু bindumag.com
এখন কথা হল, বাঙলাদেশে সিরিয়াস পাঠক সংখ্যা কতজন? ৬৪টি জেলায় যদি অন্তত গড় ২০ জন করেও ধরি, তাহলে সংখ্যাটি দাঁড়ায় ১২৮০। অথচ একেকটি লিটল ম্যাগাজিন বিক্রির পরিমাণ তিন-চারটি ব্যতিক্রম বাদ দিলে সাধারণত পঞ্চাশের কাছাকাছি যায় না।
বিন্দু bindumag.com
আজকের প্রবীণ লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদকগণ যে বয়সে প্রকাশনা শুরু করেছিলেন, আজকের সময়ে সেই বয়সের তরুণরা কী করছেন? এই তরুণরাও কেউ কেউ লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশ করছেন, যার অধিকাংশই ইন্টারনেটভিত্তিক। কেননা অনেক কম খরচে তুলনামূলক সহজসাধ্য প্রকাশমাধ্যম হিসেবে এখন এটি মধ্যবিত্তের হাতের নাগালে রয়েছে। নিয়মিতই কাগজে/ইন্টারনেটে বর্তমান প্রজন্মের তরুণদের লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশিত হচ্ছে। এর প্রধান কারণ প্রবীণ/অতিপ্রবীণ লিটল ম্যাগাজিনগুলো তাদের জন্মদশকের চিন্তা-দর্শন-কাঠামো আঁকড়ে থাকায় নতুন চিন্তা-দর্শন-কাঠামো গ্রহণ করতে পারছে না। এইসব, একেকটি অতিক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়ে পুরোনো ব্যবস্থা-কাঠামোকেই টিকিয়ে রাখার ব্যর্থ চেষ্টার অংশ হিসেবে অপরকে সার্টিফিকেট দেয়ার মতো নীলক্ষেত ঘরানার কার্যক্রমের মধ্যেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রেখেছে। মাঝেমধ্যে ছাগলের চিৎকারের সুরে বাতিল-বাতিল কোরাস সংগীত পরিচালনা করে লোকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইলেও সিরিয়াস পাঠক এদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে; আর মন দিয়েছে নতুন চিন্তা ধারণকারী কাগজ/ইন্টারনেটে প্রকাশিত তুলনামূলক তরুণদের নতুন চিন্তা-কাঠামোর লিটল ম্যাগাজিনে। নতুন চিন্তার ধারক এই তরুণরাই প্রকাশ করছেন এই সময়ের লিটল ম্যাগাজিন। এঁদেরই পাঠকসংখ্যা দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
নভেম্বর ২০১৭
কুড়িগ্রাম, বাঙলাদেশ।
[ সম্পাদকের নোট: প্রবন্ধটি ইতোপূর্বে ভারতের ‘আঙ্গিক’ ও বাঙলাদেশের ‘জঙশন’ লিটল ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছে। অনলাইনে প্রকাশের প্রয়োজনীয়তা থেকে পুনঃপ্রকাশ করা হলো। ]
এইখানে দ্বিমত আছে, আচ্ছা কোন কোন সাহিত্যিক যাদের পাঠক পড়েন বা পড়তেন যারা লিটল ম্যাগাজিন থেকে এসেছেন? আমি জানিনা, আর এখন কেউ লিটল ম্যাগাজিন বোঝেনা বোঝে ব্লগজিন ওয়েবজিন। কোন লিটল ম্যাগ জনগনের কথা বলে, জানা নাই। আমাকে তথ্যগুলো কী দেবেন?
উত্তরমুছুনলেখকের বক্তব্যের সাথে আমি একমত পোষণ করছি। একশিট কাগজ মানে গাছের একটি ডাল। অন্তত পরিবেশের স্বার্থে সবরকম পত্রিকার অনলাইনে আসা উচিত। বইগুলো হার্ডকপি থাক, কিন্তু পত্রিকাগুলো ডিজিটাল হোক। এটা প্রথম কথা। দ্বিতীয় কথা হল যে লিটল ম্যাগাজিন অনলাইনে আসা যাবে না - এটাও একটা পশ্চাতপদ চিন্তা। জয়নুল আবেদীন বস্তার উপরেও কয়লার টুকরো দিয়ে চিত্র একেছিলেন। তাই বলে সেসব চিত্রের আবেদন বিন্দুমাত্র কমেনি। সেটা অবশ্য ব্যতিক্রম। আমি বলতে চাই, যে মাধ্যমেই হোক না কেন যদি সুস্বাদু হয়, তাহলে মানুষ গ্রহণ করবেই। বিন্দুর অনলাইনে চলে আসা প্রমাণ করে যে বিন্দু একটি অগ্রসর চিন্তা লালন করে।
উত্তরমুছুনলিটলম্যাগের পাঠক কমছে একথা যারা বলে, তারা আসলে মার্কেটিং বোঝে না। অবশ্য কবি সাহিত্যিকদের তা বোঝারও কথা নয়। আমার কথা হল উৎসাহী পাঠকের কাছে পত্রিকা নিয়ে যেতে হবে। আমি নিজেই তো অনেক পত্রিকার খোঁজ পাই না। তাহলে সেগুলো পড়বো কিভাবে? বিন্দুকে হাতের কাছে পাচ্ছি, নিয়মিত পড়ছি। একথা অন্যরা যত তাড়াতাড়ি বুঝবেন, পাঠকের জন্য সেটা তত সুবিধার হবে।
এই প্রথম, কোন লেখা পুরোটা না পড়েই মন্তব্যে উপস্থিতি। বিষয়টা অবশ্যই আবেগের, কোন বিষয়টা আবেগের নয় তা বলুন দেখি! সাম্য রাইয়ান, সাবাস বললাম। নৈতিকতা বিষয়ক ভাবনাতে কার দড়ি কত গিরা পর্যন্ত গেল, কার দড়ি গিরা খুলে হারিয়ে গেল -এমত তর্কযুদ্ধে লুঙ্গি কাছা মেরে হাজির হয়ে গেলাম। আগেই বলেছি, সবটাই আবেগের ব্যাপার ��। আপনার লেখা এই আবেগের বেগবান হবার জন্য দায়ী। সুস্থ থাকুন ভালো থাকুন সব অর্থেই।
উত্তরমুছুনলেখকই পাঠক, পাঠকই লেখক।
উত্তরমুছুন