হে মার্কেটে সহিংসতার কোন প্রমান হাজির করতে না পারলেও রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়ন-নির্যাতন আর শাস্তির শিকার হতে হয়েছিল সিণ্ডিক্যালিস্ট শ্রমজীবী আন্দোলনের ৮ জন সমাজ বিপ্লবীকে। এদের মধ্যে ফাঁসির রজ্জুতে ঝোলানো হয়েছিল ৪ জনকে, আর ৪ জনকে দেয়া হয়েছিল জেল। অন্ধকার কক্ষগুলোতে নির্মম নিপীড়নের শিকার হয়েও মাথা নোয়াবার প্রয়োজন বোধ করেননি তারা। সেই লড়াকুদের একজন আলবার্ট আর. পার্সনস। যিনি শ্রমজীবী মানুষের আন্দোলনকে দেখেছিলেন সমাজের যাবতীয় আধিপত্য আর দাপুটে ক্ষমতার বিরুদ্ধে আন্দোলন হিসেবে। নিছক অর্খনৈতিক মুক্তির আন্দোলন নয়। প্রিয়তমা স্ত্রীকে লেথা তার শেষ চিঠিতে তিনি লিখেছেন ‘আমি এই অন্ধকুপে বসেও শেষদিন পর্যন্ত বার বার চিৎকার করে যাব: মুক্তি! ন্যায়বিচার! সাম্য!’
কুক কান্ট্রি বাসটিলে, কক্ষ নং-২৯
শিকাগো, আগস্ট ২০, ১৮৮৬
প্রিয়তমা,
আজ সকালে আমাদের বিরুদ্ধে রায়টা নিশ্চয়ই দুনিয়ার সব জালিম শাসকদের মনে স্বস্তির সুবাতাস বইয়ে দিয়েছে। আর নিশ্চয়ই শিকাগো থেকে সেইন্ট পিটার্সবুর্গ পর্যন্ত সব শাসকরা এটা উদযাপন করবে ওয়াইনের বন্যা বইয়ে দিয়ে। কিন্তু তাসত্ত্বেও আমাদের ফাঁসিটা নিশ্চয়ই ইতিহাসের দেয়ালে একটা আঁঁচড় দিয়ে যাবে। ভবিষ্যদ্বাণী করতে থাকবে: সব ঘৃণা, অশুভ কামনা, স্বার্থপরতা, আইনি হত্যা, নির্যাতন-নিপীরণ ও আধিপত্যের বিরুদ্ধে। পৃথিবীর নির্যাতিত মানুষরা আজ নিদারুণ যন্ত্রণায় ছটফট করছে আইনি শেকলে বন্দি হয়ে। কিন্তু শ্রমজীবী মানুষরা খুব বেশি দিন এমনটা থাকবে না। তাঁরা জাগছেন। সাধারণ জনগণ তাঁদের এইসব শেকল একদিন নিশ্চয়ই ভেঙ্গে ফেলবেন ঝোড়ো হাওয়ায় ভেঙ্গে যাওয়া শুকনো ডালপালার মতো। আমরা সবাই পরিস্থিতি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। যেভাবে আমাদের গড়ে তোলা হয়েছে, আমরা সেভাবেই তৈরি হয়েছি। এই সত্যটা দিনে দিনে স্পষ্ট হচ্ছে।
মৃত্যুদণ্ডাদেশ প্রাপ্ত আমাদের আটজনের একজনের বিরুদ্ধেও সেদিন হে মার্কেটে কোন ধরণের সহিংসতা ঘটানোর প্রমাণ নেই। আমরা কেউই সে ব্যাপারে কিছুই জানতাম না। তাহলে কেন আমরা এখানে? শাসক শ্রেণীর আসলে কাউকে বলি দেওয়ার দাবি ছিল। আর আমরা নিজেদের জীবনটা উত্সর্গ করেছি এইসব ক্রোধান্ধ কোটিপতিদের তীব্র-ক্ষুব্ধ চিৎকার কিছুটা থামানোর জন্য। তারা আমাদের জীবনটা ছাড়া আর কোনকিছুতেই শান্ত হওয়ার নয়। এইতো একচ্ছত্র আধিপত্য ! মুক্তি আর সত্যের কথা চিৎকার করে বলার জন্য শেকলবন্দী শ্রমিকরা আজ ফাঁসির মঞ্চে উঠতে যাচ্ছে!
প্রিয়তমা, আমি ব্যক্তিগতভাবে তোমার কাছে, আর আমাদের সন্তানদের কাছে শুধু দুঃখই প্রকাশ করতে পারি।
তুমি আমি আমরা মানুষের মুক্তির জন্য নিজকে উৎসর্গ করছি। আমি তোমাকে শুধু একটা অনুরোধই করব: আমি চলে যাওয়ার পর কোন কাজে তাড়াহুড়ো করবে না। সমাজতন্ত্রের মহান আদর্শ প্রতিষ্ঠায় আমাকে থেমে যেতে হলো, কিন্তু তুমি তোমার কাজ চালিয়ে যাবে।
আমাদের সন্তানদের বলো, বাবা জীবন দিয়েছে তাদের স্বাধীনতা-আনন্দ ছিনিয়ে আনার প্রচেষ্টায়… এটা বহুগুনে ভালো শ্রম-দাসত্ব আর দারিদ্রপূর্ণ সমাজে ধুঁকে ধুঁকে মরার চেয়ে। তাদেরকে আমার আশির্বাদ দিও।
বেঁচে থাকি বা মরেই যাই, আমরা সবসময়ই একসাথে আছি। তোমার জন্য আমার ভালোবাসা কখনো মরবে না। যেমন মানুষের জন্য মনুষ্যত্ব। আমি এই অন্ধকুপে বসেও শেষদিন পর্যন্ত বার বার চিৎকার করে যাব: মুক্তি! ন্যায়বিচার! সাম্য!
আলবার্ট আর. পারসন্স
সূত্র: লুসি পারসন্স, আলবার্ট আর. পার্সনসের জীবন; (শিকাগো: ১৮৮৯), ২১১-২১২
মন্তব্য