কার্ল মার্ক্সের সংক্ষিপ্ত জীবনী
কার্ল হাইনরিশ মার্ক্স (৫ই মে, ১৮১৮ – ১৪ই মার্চ, ১৮৮৩) একজন প্রভাবশালী জার্মান সমাজ বিজ্ঞানী ও মার্ক্সবাদের প্রবক্তা। বিংশ শতাব্দীতে সমগ্র মানব সভ্যতা মার্ক্সের তত্ত্ব দ্বারা প্রবলভাবে আলোড়িত হয়। তার তত্ত্ব সমগ্র বিশ্বকে নাড়িয়ে দিয়েছে। তিনি মানুষকে শিখিয়েছেন স্বপ্ন দেখতে ও মড়া-চেপড়া সমাজ ব্যবস্থাকে ধাক্কা মেরে চূর্ণ করে দিতে। আজও সারা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে সমাজবদলের যে লড়াই চলছে সেই সব সংগ্রামীদের মুক্তি সংগ্রামের প্রেরনা কার্ল মার্ক্স।
কার্ল মার্ক্স প্রুশিয়া সম্রাজ্যের নিম্ন রাইন প্রদেশের অন্তর্গত Trier নামক স্থানে এক ইহুদি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পরিবারের নয় সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়। বাবা হাইনরিশ মার্ক্স এমন এক বংশের লোক যে বংশের পূর্বপুরুষেরা রাব্বি ছিলেন। অবশ্য তাদের মধ্যে অতিবর্তী ঈশ্বরবাদ এবং আলোকময়তার যুগের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। তাদের অনেকেই ভলতেয়ার ও রুসোর মত দার্শনিকদের প্রশংসা করতেন। জন্মের সময় হাইনরিশ মার্ক্সের নাম ছিল Herschel Mordechai, তার বাবার নাম Levy Mordechai (১৭৪৩-১৮০৪) এবং মা'র নাম Eva Lwow (১৭৫৩-১৮২৩)। ইহুদি পরিবারেই হাইনরিশের জন্ম, কিন্তু ধর্মের কারণে আইন অনুশীলনে বাধাগ্রস্ত হওয়ায় তিনি ইহুদি ধর্ম ত্যাগ করে লুথারীয় মতবাদে দীক্ষা নেন। লুথারীয় ধর্ম তখন প্রুশীয় সাম্রাজ্যের রাষ্ট্রীয় প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্ম ছিল, তাই সেই রোমান ক্যাথলিক সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রে লুথারীয় সংখ্যালঘু হিসেবে বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা লাভের আশায়ই তিনি এভাবে ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন।
bindumag.com
কার্ল মার্ক্স ১৩ বছর বয়স পর্যন্ত বাড়িতেই পড়াশোনা করেন। বাল্যপাঠ শেষে Trier Gymnasium এ ভর্তি হন, ১৭ বছর বয়সে সেখান থেকে স্নাতক হন। এরপর ইউনিভার্সিটি অফ বন-এ আইন বিষয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। তার ইচ্ছা ছিল সাহিত্য ও দর্শন নিয়ে পড়া, কিন্তু তার বাবা মনে করতেন কার্ল স্কলার হিসেবে নিজেকে প্রস্তুত করতে পারবে না। কিছুদিনের মধ্যেই তার বাবা তাকে বার্লিনের Humboldt-Universität এ বদলি করিয়ে দেন। সে সময় মার্ক্স জীবন নিয়ে কবিতা ও প্রবন্ধ লিখতেন, তার লেখার ভাষা ছিল বাবার কাছ থেকে পাওয়া ধর্মতাত্ত্বিক তথা অতিবর্তী ঈশ্বরবাদের ভাষা। এ সময়ই তরুণ হেগেলিয়ানদের নাস্তিকতাবাদ গ্রহণ করেন। ১৮৪১ সালে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। তার পিএইচডি অভিসন্দর্ভের বিষয় ছিল "The Difference Between the Democritean and Epicurean Philosophy of Nature" (প্রকৃতি সম্বন্ধে দেমোক্রিতোসীয় ও এপিকুরোসীয় দর্শনের মধ্যে পার্থক্য)। উল্লেখ্য, পিএইচডি অভিসন্দর্ভ তিনি বার্লিনের বিশ্ববিদ্যালয়ে জমা না দিয়ে ইউনিভার্সিটি অফ জেনাতে জমা দেন। কারণ তরুণ হেগেলিয়ান র্যাডিকেল হওয়ার কারণে বার্লিনে তার ভাবমূর্তি ভাল ছিল না।
বার্লিনের বিশ্ববিদ্যালয়ে দুটি ভাগ ছিল। তরুণ হেগেলিয়ান, দার্শনিক ছাত্র এবং লুডউইগ ফয়েরবাক ও ব্রুনো বাউয়ারকে কেন্দ্র করে গঠিত সাংবাদিক সমাজ ছিল বামপন্থী। আর শিক্ষক সমাজ ছিল জি ডব্লিউ এফ হেগেল। এই দুটি ভাগ ছিল পরস্পরবিরোধী। হেগেলের অধিবিদ্যাগত অনুমিতিগুলোর সমালোচনা করলেও বামপন্থীরা প্রতিষ্ঠিত ধর্ম ও রাজনীতির কঠোর সমালোচনার জন্য হেগেলের দ্বান্দ্বিক পদ্ধতিই অনুসরণ করতো।
bindumag.com
কিছু তরুণ হেগেলিয়ান এরিস্টটল-উত্তর দর্শনের সাথে হেগেল-উত্তর দর্শনের সাদৃশ্য তুলে ধরেন। যেমন, মাক্স স্টির্নার তার Der Einzige und sein Eigenthum (১৮৪৪) বইয়ে ফয়ারবাখ ও বাউয়ারের সমালোচনা করেন, বিমূর্ত ধারণাগুলোর দ্ব্যর্থতাবোধক হেত্বাভাস (reification) চর্চার জন্য তাদেরকে ধার্মিক ব্যক্তি বলে আখ্যায়িত করেন। মার্ক্স এই বই পড়ে মুগ্ধ হয়ে ফয়ারবাখের বস্তুবাদ ত্যাগ করেন। এই রূপতাত্ত্বিক বিরতি (epistemological break) ঐতিহাসিক বস্তুবাদ বিষয়ে তার ধারণার ভিত্তি রচনায় যথেষ্ট সাহায্য করে। এই নতুন ধারণার মাধ্যমে তিনি স্টির্নারেরও বিরোধিতা করেন। এ বিষয়ে একটি বইও লিখেন যার নাম Die Deutsche Ideologie (১৮৪৫)। অবশ্য ১৯৩২ সালের আগে এই বই প্রকাশের মুখ দেখেনি।
১৮৪৩ সালের অক্টোবর মাসের শেষের দিকে মার্ক্স প্যারিসে আসেন। এ শহর তখন জার্মান, ব্রিটিশ, পোলীয় ও ইতালীয় বিপ্লবীদের সদর দফতর হয়ে উঠেছিল। তিনি প্যারিসে গিয়েছিলেন মূলত জার্মান বিপ্লবী Arnold Ruge এর সাথে Deutsch-Französische Jahrbücher-এর উপর কাজ করতে। সে সময় ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস প্যারিসে গিয়েছিলেন মার্ক্সকে ১৮৪৪ সালের বাস্তবতায় ইংল্যান্ডে কর্মজীবী মানুষের অবস্থা অবহিত করতে। এর আগে ১৮৪২ সালে মার্ক্সের সাথে এঙ্গেল্সের এ নিয়ে কথা হয়েছিল। সে পরিচয়ের ভিত্তিতেই এঙ্গেল্স এ ধরণের উদ্যোগ নেন। এভাবেই ১৮৪৪ সালের ২৮শে অক্টোবর মার্ক্স ও এঙ্গেল্স প্যারিসের Café de la Régence-তে তাদের বন্ধুত্ব জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের সূচনা ঘটান। এটা ছিল ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বুদ্ধিবৃত্তিক বন্ধুত্বের একটি।
bindumag.com
Deutsch-Französische Jahrbücher-এর পতন হওয়ার পর মার্ক্স প্যারিসের সবচেয়ে প্রগতিশীল জার্মান পত্রিকায় ("লিগ অফ দ্য জাস্ট" নামক গোপনীয় সমাজ এটা প্রকাশ করতো) একটি প্রবন্ধ লিখেন। এই প্রবন্ধের বিষয় ছিল "ইহুদি প্রশ্ন" এবং হেগেল। লেখালেখির বাইরে মার্ক্সের সময় কাটতো ফরাসি বিপ্লবের ইতিহাস, Pierre-Joseph Proudhon এর রচনা এবং গ্রাম্য প্রোলেতারিয়াদের কথা পড়ে। এ সময় প্রোলেতারিয়াদের অবস্থা নিয়ে তার বিশেষ আগ্রহ সম্পর্কে উইলিয়াম এইচ সিউয়েল জুনিয়র তার ওয়ার্ক অ্যান্ড রিভলিউশন ইন ফ্রান্স গ্রন্থে বলেন, “... মার্ক্সের হঠাৎ করে প্রোলেতারীয় কারণ সম্বন্ধীয় মতবাদের প্রতি সমর্থনের সাথে এর আগে ফ্রান্সের সমাজতান্ত্রিক বুদ্ধিজীবী সমাজের সাথে তার নিবিঢ় যোগাযোগের সরাসরি সম্পর্ক স্থাপন করা যায়।”
মার্ক্স তরুণ হেগেলিয়ানদের সাথে তার সম্পর্কের পূনর্মূল্যায়ন করেন। ১৮৪৩ সালে বাউয়ারের নাস্তিকতার জবাবে রচিত "অন দ্য জিউইশ কোয়েশ্চ্ন" এই পুনর্মূল্যায়নেরই অংশ। এ সময়ই আরেকটি প্রবন্ধ লিখেন যার বিষয় ছিল রাজনৈতিক মুক্তি, ইহুদি ও খ্রিস্টান ধর্ম কিভাবে মানুষের মুক্তির বিরোধিতা করে এবং বেসামরিক ও মানবাধিকার বিষয়ে সমকালীন দৃষ্টিভঙ্গির সমালোচনা। প্রত্যয়ী সাম্যবাদী এঙ্গেল্স মার্ক্সের অর্থনৈতিক গবেষণাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যান এবং কর্মজীবী শ্রেণীর অবস্থার প্রতি তার উৎসাহ সৃষ্টি করেন। এভাবেই মার্ক্স সাম্যবাদী হয়ে উঠেন, ইকোনমিক অ্যাণ্ড ফিলোসফিক্যাল মেনুস্ক্রিপ্ট্স অফ ১৮৪৪ (১৯৩০-এর দশকের আগে প্রকাশিত হয়নি) রচনার মাধ্যমে সাম্যবাদ বিষয়ে তার মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করেন, পুঁজিবাদী সমাজে বিচ্ছিন্ন (এলিয়েনেটেড) কর্মজীবী শ্রেণীর বিপরীতে সাম্যবাদী সমাজে সম্পৃক্ত (আন-এলিয়েনেটেড) কর্মজীবী শ্রেণীর কথা বলেন। তার মতে, এ ধরণের সাম্যবাদী সমাজে সবাই নিজেদের স্বাধীনভাবে গড়ে তুলতে পারে এবং পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে উৎপাদন ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটাতে পারে।
১৮৪৫ সালের জানুয়ারিতে যখন Vorwärts প্রুশিয়ার রাজা ফ্রিডরিক উইলিয়াম ৪-কে হত্যার প্রচেষ্টাকে অনুমোদন দেয় তখন প্যারিস থেকে কার্ল মার্ক্স সহ সব বিপ্লবীকে বহিষ্কার করা হয়। তিনি এঙ্গেল্সের সাথে ব্রাসেল্স চলে যান। এখানেই ঐতিহাসিক বস্তুবাদকে সম্পূর্ণ করার জন্য ইতিহাস অধ্যয়ন করেন। এরই ধারাবাহিকতায় তার দ্য জার্মান আইডিওলজি-তে (১৮৪৫) বলেন, প্রতিটি ব্যক্তির স্বভাব-প্রকৃতি তাদের উৎপাদন নির্ধারণকারী বস্তুর শর্তের উপর নির্ভর করে। এর মাধ্যমেই উৎপাদনের নকশা প্রণয়ন করেন এবং শিল্পকেন্দ্রিক পুঁজিবাদের পতন ও তার বদলে সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার ভবিষ্যদ্বাণী করেন।
এর পরই ফরাসি সমাজতন্ত্রের সমালোচনা প্রকাশ করেন যার নাম ছিল দ্য পোভার্টি অফ ফিলোসফি (১৮৪৭)। এটা ছিল Pierre-Joseph Proudhon রচিত "দ্য ফিলোসফি অফ পোভার্টি"-র (১৮৪৭) প্রত্যুত্তর। বুদ্ধিবৃত্তিক দিক দিয়ে চিন্তা করলে মার্ক্সের দ্য জার্মান আইডিওলজি এবং দ্য পোভার্টি অফ ফিলোসফি-ই পরবর্তীতে প্রকাশিত দ্য কমিউনিস্ট মেনিফেস্টোর মূল ভিত্তি। এই ইশতেহার ছিল কমিউনিস্ট লিগ-এর মূলনীতি।
প্যারিসে প্রত্যাবর্তন
১৮৪৮ সালে ইউরোপ জুড়ে প্রচুর বিপ্লব সংঘটিত হয়। অনেক কিছুই বদলে যায়। মার্ক্সকে বন্দী করা হয় এবং পরবর্তীতে বেলজিয়াম থেকে বহিষ্কার করা হয়। এরই মধ্যে বিপ্লবীরা ফ্রান্সের রাজা লুই-ফিলিপ কে রাজি করিয়ে মার্ক্সকে প্যারিসে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করে। রাজার আমন্ত্রণেই তিনি প্যারিসে প্রত্যাবর্তন করেন। এ সময় প্যারিসে জুন ডেইস আপরাইজিং নামে পরিচিত বিপ্লবটি সংঘটিত হয় যা মার্ক্স প্রত্যক্ষ করেন।
bindumag.com
প্যারিসে জুন ডেইস আপরাইজিং শেষ হওয়ার পর ১৮৪৯ সালে মার্ক্স জার্মানির Cologne শহরে ফিরে যান এবং Neue Rheinische Zeitung পত্রিকাটি প্রকাশ করতে শুরু করেন। এই পত্রিকা প্রকাশকালীন সময়েই তাকে দুই বার অভিযুক্ত করা হয়। প্রথম বার ১৮৪৯ সালের ৭ই ফেব্রুয়ারি press mis-demeanour crime প্রকাশের জন্য এবং পরের বার একই বছরের ৮ই ফেব্রুয়ারি incitement to armed rebellion প্রকাশের জন্য। দুই বারই তিনি অব্যাহতি পেয়ে যান। কিন্তু এই ধারাবাহিকতায় আরও বাঁধা আসতে থাকে। একসময় পত্রিকাটি নিষিদ্ধ ঘোষিত হয় এবং তাকে প্যারিসে ফিরে যেতে বাধ্য করা হয়। কিন্তু প্যারিস তাকে শরণার্থী হিসেবে গ্রহণে অস্বীকৃতি জানায়, অগত্যা লন্ডনে চলে যান। লন্ডন তাকে ইউরোপ মহাদেশের একজন শরণার্থী হিসেবে গ্রহণ করে।
bindumag.com
লণ্ডন
১৮৪৯ সালের মে মাসে কার্ল মার্ক্স লণ্ডনে যান এবং ব্রিটেনে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করেন। ১৮৫১ সালে নিউ ইয়র্ক ট্রিবিউন-এর স্থানীয় সংবাদদাতা হিসেবে কাজ শুরু করেন, এতে তার জীবিকা অর্জনেও সুবিধা হয়। ১৮৫৫ সালে মার্ক্স পরিবারের সন্তান এডগার যক্ষ্ণায় আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। এসব কারণে কয়েক বছর রাজনৈতিক অর্থনীতির কাজ বেশ ধীরগতিতে চলে। ১৮৫৭ সালে ৮০০ পৃষ্ঠার একটি পাণ্ডুলিপির কাজ শেষ করেন। এই ৮০০ পৃষ্ঠায় মূলধন, ল্যাণ্ডেড প্রোপার্টি, মজুরি শ্রম, রাষ্ট্র, বৈদেশিক বাণিজ্য এবং বিশ্ব বাজার বিষয়গুলো স্থান পায়। এই পাণ্ডুলিপিটি ১৯৪১ সালে Grundrisse der Kritik der Politischen Ökonomie (রাজনৈতিক অর্থনীতির সমালোচনার সাধারণ পরিচিতি) নামে প্রকাশিত হয়। বইটির সংক্ষিপ্ত নাম ছিল Grundrisse। ১৮৫৯ সালে প্রকাশ করেন কন্ট্রিবিউশন টু দ্য ক্রিটিক অফ পলিটিক্যাল ইকোনমি যা তার অর্থনীতি বিষয়ক পরিপক্ক প্রকাশনাগুলোর মধ্যে প্রথম হিসেবে বিবেচিত হয়। একইসাথে সংবাদ প্রতিবেদক হিসেবে মার্ক্স মার্কিন গৃহযুদ্ধের (১৮৬১-১৯৬৫) ইউনিয়ন কারণ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠেন।
bindumag.com
১৮৬০-এর দশকের প্রথম দিকে মার্ক্স তিনটি খণ্ড রচনা শেষ করেন। প্রথম খণ্ডের নাম থিওরিস অফ সারপ্লাস ভ্যালু। এর প্রধান আলোচ্য বিষয় ছিল কয়েকজন রাজনৈতিক অর্থনীতি তাত্ত্বিকদের (বিশেষত অ্যাডাম স্মিথ ও ডেভিড রিকার্ডো) মতবাদ। সম্পাদক Karl Kautsky মার্ক্সের মৃত্যুর পর এটা প্রকাশ করেন। আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষিত না হলেও এই খণ্ডকে ডাস কাপিটাল-এর "চতুর্থ পুস্তক" হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়। অর্থনৈতিক চিন্তাধারার ইতিহাস নিয়ে জ্ঞানগর্ভ রচনাগুলোর এটাই প্রথম। ১৮৬৭ সালে তিন খণ্ডে ডাস কাপিটাল প্রকাশিত হয়। প্রথম খণ্ড ডেভিড রিকার্ডো প্রণীত মূল্যের শ্রম নীতি-কে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করে এবং সে দৃষ্টিকোণ থেকে উদ্বৃত্ত মূল্য নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে শ্রমিকদের শোষণকারী পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থার বিশ্লেষণ করে। মার্ক্স এতে বলেন, এই উদ্বৃত্ত মূল্য ও শোষণের কারণে একসময় পুঁজিবাদীদের লাভের হার একেবারে কমে যাবে এবং যথারীতি শিল্পকেন্দ্রিক পুঁজিবাদের পতন ঘটবে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় খণ্ড মার্ক্সের জীবদ্দশায় পাণ্ডুলিপি পর্যায়েই থেকে যায়, তিনি এ দুটোর আরও উন্নয়ন ঘটান। তার মৃত্যুর পর এঙ্গেলস এগুলো সমাপ্ত করেন এবং প্রকাশ করেন।
bindumag.com
ডাস কাপিটাল প্রকাশে একটু দেরী হয়, কারণ মার্ক্স তখন প্রথম আন্তর্জাতিক এর কাজ নিয়ে ব্যস্ত। ১৮৬৪ সালে মূল জেনারেল কাউন্সিলে নির্বাচিত হন। কাউন্সিলের সদস্য হিসেবে ইন্টারন্যাশনাল-এর প্রথম বার্ষিক সভার প্রস্তুতি গ্রহণ এবং মিখাইল বাকুনিন (১৮১৪-১৮৬৭) এর অ্যানার্কিস্ট দলের সাথে অন্তর্ঘাতী বিরোধে নেতৃত্ব দানের দায়িত্ব তার উপরই পড়ে। এই বিরোধে তিনি জয়ী হন, কিন্তু ১৮৭২ সালে তারই সমর্থনে জেনারেল কাউন্সিলের সভাস্থল লণ্ডন থেকে নিউ ইয়র্কে সরিয়ে নেয়ার কারণে ইন্টারন্যাশনালের পতন ত্বরান্বিত হয়। ইন্টারন্যাশনালের সবচেয়ে বড় সাফল্য ছিল ১৮৭১ সালের প্যারিস কমিউন। এই কমিউনের মাধ্যমে প্যারিসের বিপ্লবীরা ফরাসি সরকারের বিরোধিতা করে দুই মাস শহরের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখে, অবশেষে রক্তাক্ত সংঘর্ষের মাধ্যমে সরকার পুনরায় নেতৃত্ব নিয়ে নেয়। মার্ক্স তার দ্য সিভিল ওয়ার ইন ফ্রান্স রচনায় কমিউনকে সমর্থন করেছিলেন।
bindumag.com
জীবনের শেষ দশকে তার স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটে, আগের মত প্রত্যয়ী বুদ্ধবৃত্তিক আন্দোলন পরিচালনায় অক্ষম হয়ে পড়েন। অবশ্য সমসাময়িক রাজনীতি নিয়ে বক্তব্য প্রদান থেকে কখনই বিরত ছিলেন না, বিশেষত জার্মানি ও রাশিয়ার রাজনীতি নিয়ে কথা বলতেন। Critique of the Gotha Programme-এ তিনি Wilhelm Liebknecht (১৮২৬-১৯০০) এবং August Bebel (১৮৪০-১৯১৩) নামক দু'জন জার্মান অনুসারীর প্রবণতার বিরোধিতা করেন। এই দুজন ফের্দিনান্দ লাসালের রাষ্ট্রীয় সমাজতন্ত্রের সাথে সমঝোতা করার মাধ্যমে একটি ঐক্যবদ্ধ সমাজতান্ত্রিক দলের স্বার্থের পক্ষাবলম্বন করেছিল। সে সময় রাশিয়ার মির গ্রামে জমির উপর সাধারণ মালিকানা প্রবর্তন করা হয়েছিল। এসব দেখে মার্ক্স গভীরভাবে প্রত্যাশা করেছিলেন যে, অচিরেই রাশিয়ায় পুঁজিবাদী ব্যবস্থার পতনের মাধ্যমে সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যাবে।
bindumag.com
পারিবারিক জীবন
মার্ক্স জেনি ফন ভেস্টফালেন-কে বিয়ে করেন। জেনি ছিলেন এক প্রুশীয় ব্যারনের শিক্ষিত কন্যা। তাদের সম্পর্কের বিষয়টি গোপন রাখতে হয়েছিল, কারণ এই বিয়েতে মার্ক্স পরিবারের সম্মতি ছিল না। ১৮৪৩ সালের ১৯শে জুন Bad Kreuznach-এর Kreuznacher Pauluskirche-এ তাদের বিয়ে হয়।
bindumag.com
১৮৫০-এর দশকের প্রথমার্ধে মার্ক্স পরিবারের আর্থিক অবস্থা খুব একটা ভাল ছিল না। তখন তারা লন্ডনের সোহো'র ডিন স্ট্রিটে একটি তিন রুমের ফ্ল্যাট বাড়িতে থাকতেন। এরই মধ্যে তাদের চার সন্তানের জন্ম হয়। লন্ডনে বসবাস শুরু করার পর আরও তিন সন্তান হয়। এই সাত জনের মধ্যে কেবল তিনজন প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া পর্যন্ত বেঁচে ছিল। মার্ক্সের আয়ের উত্স ছিল কেবল এঙ্গেল্সের দেয়া ভর্তুকি ও নিউ ইয়র্ক ডেইলি ট্রিবিউন-এর বিদেশী সংবাদদাতা হিসেবে পাওয়া বেতন। জেনি এক কাকা ও মা'র কাছ থেকে উত্তরাধিকারসূত্র কিছু অর্থ পায়। এই অর্থই মার্ক্স পরিবারকে কেন্টিশ টাউনের ৯ গ্র্যাফ্টন টেরেস এ অপেক্ষাকৃত ভাল ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশে বাসা নিতে সাহায্য করে। আর্থিক অবস্থা খুব একটা ভাল না হলেও মার্ক্স তার স্ত্রী ও সন্তানদের বুর্জোয়া সমাজের সাথে তাল মিলিয়ে চলার জন্য আবশ্যক সব উপকরণ সরবরাহ করতেন।
bindumag.com
জেনির গর্ভে মার্ক্সের যেসব সন্তান হয়েছিল তারা হল: জেনি ক্যারোলিন (১৮৪৪-১৮৮৩), জেনি লরা (১৮৪৫-১৯১১), এডগার (১৯৪৭-১৮৫৫), হেনরি এডওয়ার্ড গাই (১৮৪৯-১৮৫০), জেনি এভেলিন ফ্রান্সেস (১৮৫১-১৮৫২), জেনি জুলিয়া এলিনর (১৮৫৫-১৮৯৮) এবং আরও কয়েকজন যারা নাম রাখার আগেই মারা যায়। বিপুল জনপ্রিয় হওয়া সত্ত্বেও কার্ল মার্ক্সের মধ্যে মানবিক চাহিদা ছিল না, এমনটা বলা যাবে না।
bindumag.com
মৃত্যু
১৮৮১ সালের ডিসেম্বরে জেনি মারা যাওয়ার পর মার্ক্স এক ধরণের catarrh-য় আক্রান্ত হন। এই রোগ তাকে জীবনের শেষ ১৫ মাস অসুস্থ করে রাখে। এই রোগ পরবর্তীতে ব্রঙ্কাইটিস ও সব শেষে pleurisy তে পরিণত হয়। এই pleurisy-র কারণেই ১৮৮৩ সালের ১৪ই মার্চ তার মৃত্যু হয়। মৃত্যুর সময় মার্ক্সের কোন জাতীয়তা তথা দেশ ছিল না, তাকে ১৭ই মার্চ লণ্ডনের হাইগেট সেমিটারিতে সমাহিত করা হয়। তার সমাধি ফলকে দুটি বাক্য লেখা আছে। প্রথমে লেখা, কমিউনিস্ট মেনিফেস্টোর শেষ লাইন "দুনিয়ার মজদুর এক হও" (Workers of all land unite), এরপরে লেখা ১১তম থিসিস অন ফয়ারবাখ-এর এঙ্গেলীয় সংস্করণের বিখ্যাত উক্তি, "এতোদিন দার্শনিকেরা কেবল বিশ্বকে বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যাই করে গেছেন, কিন্তু আসল কাজ হল তা পরিবর্তন করা।" (The Philowophers have only interpreted the world in various ways - The point however is to change it)
১৯৫৪ সালে গ্রেট ব্রিটেনের কমিউনিস্ট পার্টি কার্ল মার্ক্সের সমাধিতে একটি সৌধ স্থাপন করে যার শীর্ষে আছে মার্ক্সের মুখমণ্ডলের ভাস্কর্য। লরেন্স ব্র্যাডশ এই মুখাবয়বটির স্থপতি। প্রকৃত সমাধিটি সমতল।
মার্ক্সের শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে মাত্র ১১ জন ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন। এ সম্পর্কে এঙ্গেল্স লিখেন, “১৪ই মার্চ বিকেল পৌনে তিনটায় জীবিতদের মাঝে সেরা চিন্তাবিদ তার চিন্তার পরিসমাপ্তি ঘটান। মাত্র দুই মিনিটের জন্য আমরা তাকে রেখে বাইরে গিয়েছিলাম, ফিরে এসে তাকে তার আর্মচেয়ারে বসা অবস্থায় পেলাম, তিনি ততক্ষণে শান্তিতে নিদ্রায় গিয়েছেন- চিরদিনের জন্য।"
এঙ্গেল্স ছাড়া শেষকৃত্যে উপস্থিত অন্যান্যরা হলেন, মেয়ে এলিনর (সমাজবাদী ও বাবার সম্পাদনা সহযোগী), মেয়েদের ফরাসি সমাজবাদী স্বামী Charles Longuet ও Paul Lafargue, Liebknecht (জার্মান সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রতিষ্ঠাতা), Longuet (ফরাসি শ্রমজীবী রাজনীতির বিখ্যাত ব্যক্তি); Friedrich Lessner (১৮৫২ সালে Cologne-এ সাম্যবাদীদের বিচারের পর তিন বছর কারাদণ্ড ভোগ করেছিলেন), G. Lochner (কমিউনিস্ট লিগের অন্যতম প্রবীণ সদস্য), Carl Schorlemmer (ম্যান্চেস্টারে রসায়নে অধ্যাপক, রয়েল সোসাইটির সদস্য এবং কমরেড); Ray Lankester, স্যার জন নো এবং লিওনার্ড চার্চ। ফরাসি ও স্পেনীয় শ্রমিকদের পক্ষ থেকে আসা দুটি চিঠি পড়ে শোনানো হয়, এর সাথে এঙ্গেল্স বক্তৃতা দেন, এ-ই ছিল শেষকৃত্যের আনুষ্ঠানিকতা।
মন্তব্য