এই অপেক্ষা ছায়ার মতন। রাতের পর রাত দিনের পর দিনগুলা ঘড়ির ডায়ালের টিকটিকির পিঠে ছুটে যাচ্ছে। ছেলেটি আমার বেশি দিনের চেনা নয়। প্রচুর সিগারেট খায়। আবেগ আর নষ্টালজিয়ায় পিএইচডি করা। কখনো কখনো খাতা কলমে কিছু লেখার চেষ্টা করে। ছেলেটার লেখা থেকেই প্রথম সেনোরিতার কথা জানতে পারি। সেনোরিতা খুব ভালো এবং খুব মিষ্টি একটা মেয়ে। সেনোরিতা দূরদর্শী, গোছানো, সংসারী এবং বাবা মায়ের বাধ্যগত। এমনটা হয়েছে ছেলেটার থেকেও মনে হয় আমি সেনোরিতা সম্পর্কে বেশি জেনে ফেলছি। সেনোরিতা একটু নিঃসঙ্গ টাইপের মেয়ে। অল্প সংখ্যক বন্ধু বান্ধবের মধ্যে সেই ছেলেটা একজন।
বিন্দু bindumag.com
আচ্ছা ছেলেটার একটা নাম দেয়া যাক। যদিও ছেলেটা বর্তমানে আমার মালিক। মালিকের নাম আমার দেয়া হয়তো ঠিক হচ্ছে না। আসলে প্রচলিত ধারণা মতে মনিবেরাই নাম দেয়ার ক্ষমতা রাখে। তবে একসময় খুব সম্ভবত মালিকানা পরিবর্তন হতে পারে। তখন সে আর আমার মালিক থাকবে না আমি জানি। তাছাড়া গল্পের প্রয়োজনে তাকে আমরা রবার্ট বলে ডাকতেই পারি। রবার্টের সবচেয়ে বড় বদ অভ্যাস হচ্ছে সিগারেট। রবার্টের একটা বড় গুণ কিংবা বিশেষ চোখে দেখলে দোষ বলা চলে তা হচ্ছে কথার খোঁচা। সে মর্মভেদী বাঁকা কথার অধিকারী।
বিন্দু bindumag.com
একদিন রবার্ট আর সেনোরিতা ঘুরতে গিয়েছিলো। সেই ভ্রমণকাহিনী রবার্টের কাছেই শোনা। ওরা দুজন পাশাপাশি হেঁটে যাচ্ছিল। রবার্ট সেনোরিতার মুখ থেকে চোখ ফেরাতে পারছিল না। সেনোরিতা হঠাৎ রেগেমেগে বলে উঠে, এই এরকম গরুর মতন গোলগোল চোখে কী দেখিস? উস্টা খাবি তো। ওরা দুইজন একটা গ্রামের মেঠো পথে হেঁটে যাচ্ছিল। রবার্ট সেনোরিতার সেই ধমকে সম্বিত ফিরে পেয়ে বলে, ওদিকের দিগন্তে আকাশ নেমেছে মাটিতে। তখন সেনোরিতা বলে, কচু। আর কাব্য ফলাতে হবে না। এদিকে তো সব খড়ের গাদা। তুই আকাশ আর দিগন্ত পেলি কোথায়? রবার্ট এবার ওদিকে তাকিয়ে সত্যি বড় রকম হোঁচট খায়। ওদিকে সারি সারি খড়ের গাদা পাহাড়ের মতন দাঁড়িয়ে আছে। সে কঁকিয়ে বলে উঠে, মানুষ এত খড়ের গাদা দিয়ে কী করে? এরকম বোকা বোকা প্রশ্ন শুনে সেনোরিতা ঝর্ণাধারার মতন খিলখিল হেসে উঠে। গল্পটা আমি বহুবার রবার্টের কাছে শুনেছি। শুনে যতদূর মনে হয়েছে এটা রবার্টের স্বপ্ন, বাস্তব কোনো অভিজ্ঞতা নয়।
বিন্দু bindumag.com
সেদিন রবার্টের কাছে জানলাম কোন দেশে নাকি প্রচণ্ড ভূমিকম্পে অসংখ্য মানুষ মারা গেছে। কোন সাগরে যেন অনেকগুলা মানুষ ভেসে বেড়াচ্ছে, তাদের আশ্রয়ের জন্য কোনো দেশ নাই। আবার কোন দেশে না কি কাতারে কাতারে মুক্তচিন্তকদের গলা কেটে মেরে ফেলছে। এছাড়া আছে সাম্রাজ্যবাদ, মৌলবাদ, শ্রেণীবৈষম্য, লিঙ্গবৈষম্য । তারপর ধর্ষণ, নারী নির্যাতন, যৌন হয়রানি তো আছেই। যদিও আমার ঘর এবং আমার পৃথিবী হচ্ছে রবার্টের একটা ছিমছাম অগোছালো ড্রয়ার। তবে আমার মনে হয়, পৃথিবীতে পৃথক কোনো দেশ থাকা উচিত নয়। গোটা পৃথিবীটাই হওয়া উচিত একটা গ্রামের মতন। যেখানে এতবড় মহাবিশ্ব ছুটে যাচ্ছে একটা বিশেষ উদ্দেশ্যে এবং সেই মহাবিশ্বের তূলনায় পৃথিবীটা একটা বালুকণার মতন। সেখানে অবশ্যই সেই বালুকণাকে পৃথক করার কিছু নাই। এই পৃথিবী নামক মহাবিশ্বের একটি গ্রামে যদি সকলেই শ্রেণীবৈষম্য হিংসা ঘৃণা ভুলে, ভালোবেসে একাট্টা হয়ে থাকে তবে পৃথিবীটা অবশ্যই হবে সবচেয়ে উৎকৃষ্ট বাসস্থান। যাক সে কথা, আমার এরকম ভাবনায় পৃথিবীর হয়তো কিছু যায় আসে না কিংবা হয়তো অনেক কিছুই আসে যায়।
বিন্দু bindumag.com
রবার্টের সাথে আমার খুব কথা হয়। যদিও সব কথা সে-ই বলে। তবে সে জানে যে, আমিই তার একমাত্র শ্রোতা। সেদিন রবার্টের কাছে একটা চোরের গল্প শুনলাম। চোরটা নাকি গ্রামের সবচেয়ে সেরা চোর ছিল। বর্ডারের কাছেই সেই গ্রাম। কিন্তু একদিন চোরটা চুরি করা ছেড়ে দেয়। চুরি ছেড়ে সে প্রতিদিন একটা সাইকেলে করে বর্ডার ক্রস করে প্রতিবেশী দেশে চলে যেত। সাথে নিতো একটা খালি বস্তা। কিন্তু বিকেলে যখন আবার গ্রামে ফিরে আসতো তখন সে বস্তা ভর্তি করে কিছু একটা নিয়ে আসতো। সেই গ্রামের পুলিশ ইন্সপেক্টর চোরকে খুব ভালোভাবেই চিনতেন। তিনি অবাক হলেন, চোরের চুরি করা ছেড়ে দেয়া দেখে। একবার চোর যখন বস্তা ভর্তি করে বর্ডার থেকে আবার গ্রামে ফিরছিল। তখন পুলিশ গিয়ে সেই বস্তা খুলতে বলল। তারা ভেবেছিল চোর নিশ্চয় বস্তার ভিতর কিছু নিয়ে এসেছে। কিন্তু ইন্সপেক্টর বস্তা চেক করে অবাক হয়ে দেখলেন সেখানে বালু ছাড়া কিছু নাই। ইন্সপেক্টর জিজ্ঞেস করেন, বালু দিয়া কী করবি? চোর বলে, বাড়ি বানামু স্যার। তাই প্রতিদিন এক বস্তা কইরা সস্তায় ওপাড় থেইকা বালু আনি। ইন্সপেক্টর বেশ অবাক হলেন। এভাবেই চলতে থাকে বস্তাভর্তি বালু আনা।
বিন্দু bindumag.com
ইন্সপেক্টর জানতেন চোর নিশ্চয় ভিতরে ভিতরে কিছু করছে। কিন্তু সে তা ধরতে পারে না। এভাবে চলতে চলতে একদিন ইন্সপেক্টরের রিটায়ারমেন্ট হয়ে গেল। তারপর সে একদিন চোরকে খুব অনুনয় বিনয় করে জানতে চাইলো সেই বালুর রহস্য। চুরি না করে চোর কীভাবে সংসার চালাচ্ছে। তখন চোর বলে, স্যার আপনেরা ঠিক ধরতে পারেন নাই। আমি প্রতিদিন এপাড় থেইকা পুরান সাইকেল নিয়া যাইতাম আর সেটা বদলে নতুন সাইকেল নিয়া আসতাম। চোখে ধূলা দিতে বস্তার নাটক করতাম স্যার। আসলে আমি সাইকেল চুরি করতাম! ইন্সপেক্টর চোরের বুদ্ধিতে পুরোপুরি অবাক হয়ে গেলেন।
বিন্দু bindumag.com
গল্পটা শুনে আমিও কম অবাক হইনি। খুব মজা পাইনি, তবে অবাক লেগেছে চোরের বুদ্ধিতে। রবার্ট এরকম অনেক গল্প করে আমার সাথে। আর সব গল্পের পর অবশ্যই সেনোরিতার কথা চলে আসে। ছেলেটা পাগলা কিসিমের। তবে সবচেয়ে বাজে লাগে গল্পের সাথে সাথে তার সিগারেটের রিঙের উচ্চতা দেখে। তার সিগারেটের রিঙের উচ্চতা বাড়তে থাকে। সে বলে, সিগারেট ছাড়া না কি সে বেঁচে থাকতে পারবে না। সিগারেট হচ্ছে অমৃত। নারী যেমন প্রেম ,সেক্স আর শিল্পের বিশেষ রহস্যময় রস। সেরকম না কি সিগারেটও গল্প কবিতার ইগনিটর। এ ব্যাপারে আমি তেমন কিছু বলতে পারবো না। সেনোরিতা না কি একবার নিজের আইসক্রিমের বাটি থেকে দুই চামচ রবার্টের বাটিতে দিয়েছিল। সেইবারের সেই আইসক্রিমের থেকে ভালো আইসক্রিম নাকি রবার্ট জীবনেও খায় নাই। সেই আইসক্রিম নাকি ছিল অমৃত। ছেলেটা মেয়েটাকে পাগলের মতন ভালোবাসে। মেয়েটাও হয়তো ভালোবাসে। যেহেতু আমি সেনোরিতার কাছে কখনো গল্প শুনি নাই তাই নিশ্চয়তার সাথে বলতে পারছি না।
বিন্দু bindumag.com
তবে রবার্টের সাথে থেকে থেকে আমিও কেমন উলটপালট হয়ে গেছি। আমার খুব মানবজীবন পাওয়ার সাধ হয়। অথচ রবার্ট বলে, পৃথিবীতে জন্ম নেয়াটা হচ্ছে সবচেয়ে বড় ভুল। সবচেয়ে নাকি ভালো হত যদি মায়ের গর্ভেই থেকে যাওয়া গেলে। কিংবা একেবারেই জন্ম না নিলে। তবু আমার মানবজনমের সাধ জাগে। আমি যদি মানুষ হতাম তবে আমিও সেনোরিতাকেই ভালোবাসতাম। আমার ইচ্ছে হয় সারাদিন সারাবেলা তার পায়ে রুনুঝুনু বেজে চলতে। তার সকল গল্পের সাক্ষী হতে। যদিও এরকম একটা সম্ভাবনা আমার এই জীবনে পাওয়া খুবই সম্ভব। মানবজনম পেলে হয়তো রবার্টের মতন এই সুযোগটা আমি হারাতাম। আমি অপেক্ষার প্রহর গুণছি, কবে সেনোরিতার পায়ে রুনুঝুনু বেজে উঠবো। রবার্টও অপেক্ষায় আছে। হয়তো সেনোরিতাও। এই অপেক্ষা ছায়ার মতন...
কবি, অনুবাদক ও গল্পকার
ভাল
উত্তরমুছুন