লিখেছেন: আহমেদ মওদুদ
প্রায় অর্ধযুগেরও বেশী সময় আগে বিন্দুর সাথে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। তারও প্রায় অর্ধযুগ আগে বিন্দু’র যাত্রার শুরু হয় সাহিত্যের কাগজ হিসেবে, শিল্পীর দাঁড়াবার মতো একটি জায়গা বা স্ট্যাণ্ড পয়েন্ট হিসেবে। বিন্দুর বয়স এখন একযুগ; যা সাহিত্যে একটা দশককে স্বাক্ষী রেখে দুই বছর এগিয়ে আছে। এই এক যুগে বিন্দু সাহিত্যের নানা গলি-ঘুপচি, ভেতর-বাহির ভ্রমণ করেছে একদল সাহসী পর্যটককে সঙ্গী করে। বলতে দ্বিধা নেই আমিও সেই পর্যটকদের মধ্যে একজন, যে কী না অপেক্ষাকৃত ভীতু আর ভীতি সঞ্চারকারী।
বিন্দু bindumag.com
সময়টা সম্ভবত দুই হাজার দশ সালের গ্রীষ্মকাল হবে। ক্যাথারসিস সম্পাদক চিনু কবীর জানালেন, কবিতার একটা ভাঁজপত্র করবেন যেটা কী না হবে আবার বিয়ের কার্ডে। মোটামুটি আট দশজন কবির কবিতা নিয়ে বের হয়ে যায় সেই কার্ড। চিনু কবির সম্পাদক, রায়হান কবীর সহ সম্পাদক। ‘স্কুল পালানো পাখি’ শিরোনামে আমার একটা কবিতা ছিল সেখানে। অন্যান্য অনেক কবির মধ্যে কবি সাম্য রাইয়ানের কবিতাটি আমার নজরে আসে বিশেষভাবে। চিনুভাই জানালেন সাম্য রাইয়ান এই সময়ের তরুন কবিদের একজন এবং ছোটকাগজ বিন্দুর সম্পাদক। বিন্দু এবং বিন্দু সম্পাদকের সাথে সেটাই ছিল প্রাথমিক পরিচয়।
বিন্দু bindumag.com
মাস দুই/তিনেক পর রংপুরে পুরাতন বাসস্ট্যণ্ড সংলগ্ন একটা টং চায়ের দোকনে স্ব-শরীরে পরিচয় হয় বিন্দু সম্পাদকের সাথে। সেইদিন সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত দীর্ঘ আড্ডা চলে। আড্ডায় অন্যান্যের মধ্যে কবি জয়েস আরিফ, কবি মঞ্জুরুল আহসান ওলী, রায়হান কবীর, নূর এ আযম দীপু, দীপক কুমার রায় প্রমূখ উপস্থিত ছিলেন। অন্যরা আড্ডা উপভোগ করলেও আমার আর সাম্যর ভাষা চালাচালি ছিল ব্যাপক তীর্যক আর অনুসন্ধিৎসু। কারণ আমি তখনও দৈনিকের একজন লেখক যদিও বা দৈনিকে আর লিখবো কী না তার চেয়ে লেখালেখিটাই আর করবো কী না এ ব্যাপারে সন্দিহান ছিলাম। সৃষ্টিশীলদের সৃজনশীল কপটতা আর ভণ্ডামিতে বিরক্ত হয়ে। অন্য দিকে সাম্য তখন প্রতিষ্ঠানবিরোধী সাহিত্যের কাগজ বিন্দুর নেতৃত্ব দিচ্ছেন। দৈনিক তথা বুর্জোয়া কাগজের অপকীর্তি উঠে আসে সাম্যর কথায় আর আমার কথায় উঠে আসে ব্যাঙ্গের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা তথাকথিত লিটল ম্যাগাজিনের কথা, যেগুলো মূলত কোন কোন শিল্পব্যাবসায়ীর ব্যবসার আধার অথবা কোন কোন কবি-সাহিত্যিকের দৈনিকের সাময়িকীতে আশ্রয় পাবার মই হিসেবে ভূমিকা রেখে যাচ্ছে। স্বভাবতই আমার আর সাম্যর আলোচনা উত্তাপ ছড়ায় সেদিনের সেই আড্ডায়।
বিন্দু bindumag.com
সেই উত্তাপই সম্ভবত বৈপরীত্যের শিসা গলাতে শুরু করে ক্রমশ এবং বিন্দু সম্পাদক সম্ভবত এটা ঠাহর করেছিলেন যে, দৈনিকের একজন লেখক যে কী না বাংলাদেশের লিটল ম্যাগাজিনের খোঁজ-খবর রাখার চেষ্টা করে এবং যে কী না সাত্যিকারের কোন ছোটকাগজের সন্ধান পেলে বা লেখার আমন্ত্রণ পেলে দৈনিককে সালাম জানাতে সময়ও নিবে না তাকে একটু বাজিয়ে দেখা যাক। এর কিছুদিন পরেই বিন্দু সম্পাদকের ফোন পেলাম। তবে বিন্দুতে লেখা দেবার জন্য নয়। বিন্দু সংশ্লিষ্ট প্রকাশনা বাঙ্ময় থেকে তিনি আমার এক ফর্মার একটি কবিতার বই প্রকাশ করতে চান। বলে রাখা ভালো, বাঙ্ময়ের প্রকাশক কবি রাশেদুন্নবী সবুজ হলেও মূলত সাম্য রাইয়ানের তত্বাবধানেই বাঙ্ময় তখন পর্যন্ত বেশ কয়েকটি এক ফর্মার বই বের করে ফেলে।
বিন্দু bindumag.com
২০০৯ সালে মাটিয়াল থেকে আমার প্রথম কবিতার বই ‘দেহের আড়ালে থাকে প্রকৃত স্বজন’ বের হয়। ২০০৯ সালের পরে লেখা আমার ক্ষুদে কবিতাগুলো নিয়েই ২০১২ সালের মার্চ মাসে বাঙ্ময় বের করে দ্বিতীয় কবিতাবই ‘দুঃস্বপ্নের চিরস্থায়ী বাগানের খণ্ড চিত্র’। একই বছর জুলাই মাসে বিন্দুর ১৩তম সংখ্যায় ২০১১ সালের শেষের দিকে লিখতে শুরু করা ‘দুঃস্বপ্নের চিরস্থায়ী বাগানে’র ৫টি কবিতা প্রকাশ করেন সম্পাদক। ওই সংখ্যাতেই বাঙ্ময় প্রকাশিত বই ‘দুঃস্বপ্নের চিরস্থায়ী বাগানের খণ্ড চিত্র’র আলোচনাও স্থান পায়।
বিন্দু bindumag.com
নভেম্বর দুই হাজার বারোর চৌদ্দতম সংখ্যা বিন্দুতেও ২টি কবিতা প্রকাশ করেন সম্পাদক। বলা চলে এভাবেই ধীরে ধীরে বিন্দুর একজন নিয়মিত লেখকে পরিণত হই আমি। ২০১৯ সালের শীতের রাতে যখন এই লেখা লিখছি তখন বিন্দু আর আমার মাঝ দিয়ে বয়ে গেছে প্রায় সাতটি হাঁড় কাপানো শীতের মৌসুম। তবে তীব্র শীতেও উষ্ণতা বাড়িয়েছে বিন্দু। বিন্দুর’র জন্য কবিতা চেয়ে, প্রবন্ধ চেয়ে, গান চেয়ে দীর্ঘ সময়ের সেই উষ্ণতায় তা দিয়ে গেছেন সাম্য। তার সাথে পরিচিত হওয়ার কিছুদিন আগেও যে আমি ভেবেছিলাম জীবনে আর লেখালেখি করবো না, সেই আমার এক ফর্মার একটি কবিতার বই প্রকাশ করে, উস্কে দিয়ে আমার হাত দিয়ে লিখিয়ে নিলেন এক ঘড়া কবিতা, গোটা কয়েক গদ্য, কবিতার, এমনকি বইয়ের আলোচনাও। সেই উস্কানিতেই এই সাত বছরে বাঙ্ময় থেকে বের হয়ে যায় আমার দুইটি কবিতাবই, একটি কিশোর উপন্যাস, একটি গবেষণা গ্রন্থ এবং একটি কিশোর উপন্যাসের দ্বিতীয় সংস্করণ। আহা, কবি সাম্য রাইয়ানের মতো এমন উস্কানী আর কে দিয়েছে কোন কালে।
বিন্দু bindumag.com
কালে কালে স্রােতের বিপরীতে সাঁতার দেওয়া সম্পাদক আর কবি-সাহিত্যিকদের পাশে নিজেকে রেখে যখন স্রােতের দিকে তাকাই তখন দেখি অনেকগুলো চেনা মুখ ক্রমশ মলিন হয়ে যাচ্ছে। না, এমন নয় যে তারা আমাকে পর করে দিয়েছে অথবা আমি তাদের পর করে দিয়েছি। কাজের গতিমুখ পাল্টেছে কেবল। কিন্তু কাজটা রয়ে গেছে একই। অর্থাৎ উভয়ই শিল্প-সাধক কেউ শিল্পের মান বৃদ্ধির চেষ্টা করছে আর কেউ শিল্পের পাশাপাশি শিল্পীর সম্মানটাও অক্ষুন্ন রাখার চেষ্টা করছে। ফারাকটা শুধু এখানেই। বলে রাখা ভাল, শিল্পীর সাথে শিল্পীর কোন বিরোধ নেই, বিরোধ কেবল সেই প্রতিষ্ঠানের সাথে যে কী না শিল্পীর মেধাকে পুঁজি আর শিল্পীর মস্তিস্ককে পুঁজ বানিয়ে ফেলে।
বিন্দু bindumag.com
তো স্রােতের বিপরীতে অর্থাৎ বিন্দুর আয়োজনে সাঁতার দিতে গিয়ে দেখলাম আরো অনেকেই সাঁতার দিচ্ছেন আর অনেকে সাঁতার দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে আছেন। এইসব সাঁতারুদের মধ্যে আছেন ভাগ্যধন বড়ুয়া, শুভ্র সরখেল, আরণ্যক টিটো, সৈয়দ সাখাওয়াৎ, মিটন আলম, মাহফুজুর রহমান লিংকন, শামীম সৈকত, রাশেদুন্নবী সবুজ, রাজীব দত্ত, মেহেরাব ইফতি, হিমালয় অংকুর প্রমুখ কবি সাহিত্যিকগণ।
বিন্দু bindumag.com
এভাবে বিপরীত স্রােতে দাঁড়িয়ে প্রতিশিল্প, জঙশন, শিরদাঁড়া, চারবাক, গাণ্ডীব, দুয়েন্দে, সূর্যঘড়ি, মেশিন, চালচিত্র, ডানার করাত, তীরের সাঁতারুরা সাঁতার দিয়ে যাচ্ছে, দিয়ে যাবেন সাহিত্যের দূর্গম দরিয়ার উদ্দেশ্যে। সন্তরণ অব্যাহত থাকুক, বিন্দুর একযুগ পূর্তিতে এই হোক প্রত্যায়।
আহমেদ মওদুদ
কবি, প্রাবন্ধিক
এই যে নষ্টালজিয়ার কথাবার্তা, এগুলা পাঠে বিশেষ আয়েশ আছে। ভালো লাগে
উত্তরমুছুন