লিখেছেন: সাজ্জাদ সাঈফ
‘কবিতা একটি শিল্প, যে-শিল্পের রয়েছে নিজস্ব ভাষা ও ভঙ্গি, যে-শিল্প নিয়ত পরিবর্তনশীল, এবং যাকে টিকে থাকতে হলে ক্রমাগত তার ভঙ্গিকে বদলে নিতে হয়’ -এজরা পাউণ্ড
বিন্দু bindumag.com
বিষয়টা একটু খুলে বলি, জীবনানন্দ দাশ তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ লিখলেন এবং পরে তা অস্বীকার করলেন, কারণ কি জানেন? এই অধ্যাপক তার লেখায় নজরুলের প্রভাব থেকে মুক্ত হতে চাইলেন, এর পরের ঘটনা বাংলা কবিতার সবচেয়ে সংহত ইতিহাস, ‘রূপসী বাংলা’, ‘মহাপৃথিবী’ ইত্যাদি বইয়ে ক্রমাগত নিজেকে উতরাতে পারলেন, এবং এই উত্তরণটা সুখের ছিলো না, রবীন্দ্রনাথ তাঁকে ‘ভাষা নিয়ে জবরদস্তি’র দোষ দিলেন, এবং পরে সেই রবীন্দ্রনাথই তাঁকে চিত্ররূপময় বলে স্বীকৃতি দিলেন ও শেষ জীবনে এরকম নতুন ধাঁচে নিজেও কিছু কবিতা লিখলেন।
বিন্দু bindumag.com
বাংলা কবিতার ভাষা ও ভঙ্গির বদলে প্রথম সাফল্য একেই বলা যায়, অতঃপর ধরুন কেউ আজকের বাংলাদেশে বসে লিখলেন-
বিন্দু bindumag.com
‘এখানে তোমার কথা ভেবে, এই প্রবাসে সমস্ত মন
আদিগন্ত ধুলায় ধুসর হলো, প্রেম সেই মর্মর পাতাদের সুর
প্রেম সেই পাতাদের ওড়াউড়ি, নিবিড় দিগন্তে!’
বিন্দু bindumag.com
এখানে লোকটি সুন্দর উপস্থাপনা দিয়ে তার প্রেমময় একাকীত্বের বয়ান করলেন, আবার একই কথা আরেকজন লিখলো ধরুন-
বিন্দু bindumag.com
‘এই একাকীত্বের প্রবাস আমাকে
প্রেমময় জানালার দিকে ডাকে, তুমি আছো
তুমি সারাদিন পথ চেয়ে আছো।’
এখানেও উপস্থাপনা মনোরম ও প্রেমবর্ণিল, অথচ এই ভঙ্গি বা আঙ্গিকে পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে প্রচুর লেখা হয়েছে, এবং এসময়কার সেই কবিতাই টিকে গেছে যা পূর্বে কারো কবিতায় দেখা যায়নি, এখন একই বিষয়ে দেখা যাক গীতল আরেকটি ভঙ্গি-
বিন্দু bindumag.com
‘তুমি নেই, আলো এসে জ্বলে
একার বাগানে, একার অথৈ জলে
মিহিন বাতাস এসে, প্রবাস জীবনে
গান করে, প্রাণ ভরে, স্মৃতির উড্ডয়নে।’
বিন্দু bindumag.com
দেখা যাচ্ছে এখানেও একই বক্তব্য, ভিন্ন ভঙ্গি নিয়ে কি সাবলীল, অথচ এটাও বহুচর্চিত কথায় ভরাট, অতঃপর কবিতা সেই শিল্প যা প্রতিনিয়ত পূর্বের বাককৌশলকে উত্তরণ করে এগোয়, এতে কোনো সন্দেহ নেই যে সবচেয়ে আনকোরা ভঙ্গি দিয়েই নতুন ও সেরা কবিতাগুলি সময়কালকে আলোকিত করে, আর মিডিয়া একে পূর্ণ সম্মান জানানোর সেরা মাধ্যম নয় বরং অনাগত পাঠকেরাই সেই মূল্যায়নের সঠিকতম মাধ্যম, এই ক্রমব্যস্ত পৃথিবীতে কবিকে তাই সচেতন হতে হয় কবিতার পূর্বাপর ইতিহাস বিষয়ে এবং তা নিজ কবিতার অস্তিত্বের তাগিদেই। আর যদি তা না হয়ে ওঠে তবেই বরং বাস্তবিক জবরদস্তি এসে ভর করবে অক্ষরে পংক্তিতে।
বিন্দু bindumag.com
একটা গল্প বলি এখন, ব়্যাঁবোর গল্প, ক্ষণিক আয়ুর এক অবিস্মরণীয় কবির গল্প, যিনি প্যাশনের টান স্তিমিত বোধ করার সাথে সাথেই নিজের সব লেখা টেখা পুড়িয়ে ফেলেছিলেন, এবং আঠারো বছর বয়সের পর লিখেননি আর একটিও লাইন। তার আগে ভেরলেইনের পরম বন্ধু ব়্যাঁবোকে নিয়ে ফরাসিদেশে তুমুল বিতর্ক উঠেছিলো, একসময় তীব্র ঝগড়ার এক পর্যায়ে তাঁকে গুলি করে বসেন ভেরলেইন, আহত ব়্যাঁবো তবু বন্ধুর পক্ষে পুলিশকে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন, একদম আনপ্রেডিক্টেবল, তাই না? এমন ক্ষ্যাপা এই কবিটি, তারপর বন্ধুর জেল হয় আর একা হয়ে পড়েন তিনি, কেউ তাঁর দিকে ফিরেও তাকায় না, পরিবারের কেউ খোঁজ নেয় না, উচ্ছন্নে যাওয়া কবিতালেখক আহামরি কোনো আদরনীয় কেউ নয়ও বৈষয়িক বিশ্বে, তবু মাথা নিচু করে বাড়ি ফিরেছেন তিনি, মা পরম আদরে ডেকে উঠলে আত্মগ্লানিতে কেঁদে ফেলেছিলেন। এই উপেক্ষা, একাকীত্ব, অভিশপ্ত কবি ইমেজ তাঁর ভিতর গড়ে দিয়েছিলো অবর্ণনীয় জেদ (আর এই মুহূর্তে প্রসঙ্গের বাইরে গিয়ে আমাদের সাহিত্যে আত্মগ্লানির উপাসক ভাস্কর চক্রবর্তী ও ফাল্গুনী রায়কেও মনে পড়ে গেলো এই দৃশ্যের পর, যাক সেকথা), মাকে খুলে বললেন সব, মায়ের সাহায্য নিয়ে সব লেখা এক করতে লাগলেন, ভাই বোনেরা মাঠে ও প্রান্তরে হুল্লোড় করে, উপার্জন করে আর একটি ছেলে সারাদিন বসে বসে লেখে, ‘নরকে এক ঋতু’ লিখে তবু বোদ্ধাদের মন জয় করতে পারলেন না, সবাই মুখের সামনে উপেক্ষাভঙ্গিটি ঝুলিয়েই রাখলো, তীব্র হতাশায় কবি সব পুড়িয়ে দিলেন, এও ছিলো তার কবিত্বের অহংকার, কারো কাছে ধর্ণা দেননি তবু, আপোষ করে খুশি করেননি কাউকে, এই তুমুল শক্তিমান কবি যখন মিডিয়ার সাথে দ্বৈরথে পাওয়া তাচ্ছিল্যকে কবিতায় বুনেছিলেন তখনো তিনি জানতেন না তিনি শতাব্দীর অন্যতম সেরা বইটি লিখছেন, রেনে শার এই ঘটনাকে উল্লেখ করে লিখেছিলেন-
বিন্দু bindumag.com
‘প্যারিসে কবিদের ন্যাকামি... লিরিক প্রসাবকারীদের সরাইখানা’
বিন্দু bindumag.com
এছাড়াও ব়্যাঁবোর ‘ইল্যুমিনেশান্স’ এর কবিতাগুলিও কবিতার প্রচলিত ধারাকে তীব্র আঘাত করেছিলো এর নতুনত্ব ও তথাকথিত সামাজিক জীবনের বিপরীতে এক অভূতপূর্ব জীবনদর্শনের ভাষিক রূপ সহযোগে, এইটেই মোদ্দা কথা, যখন সমগ্র মিডিয়াকে/প্রচলিত সমাজব্যাবস্থার অসারতাকে তুচ্ছ করা সম্ভব হয় তখন কবির জন্য উচ্চতর মিডিয়া হয়ে উঠবে শুধুমাত্র কবিতাই, এর বেশি আর কোনও বৈষ্যয়িকতার অনুগ্রহ কবির প্রয়োজন হয় না। মাইকেল মধুসূদন বলুন আর জীবনানন্দ দাশ বলুন অথবা বিনয় মজুমদার-শক্তি চট্টোপাধ্যায়-আবুল হাসান-ভাস্কর চক্রবর্তী, যার কথাই আসুক, সকল বাঙালি কবির সংহত কবিতাশক্তির পেছনের গল্প হিসেবে প্রথমেই আসবে ভাষার প্রতি অমোঘ টানের ইতিহাস। তারপরের ধাপটিকেই সাধনা নামাঙ্কিত করা হয় সমালোচনা সাহিত্যে, যেখানে পঠন-পাঠন অবলোকন ও যাপনের সমন্বয়ে কবি গড়ে তোলেন লেখনীর নিজস্ব ধার, এই ধাপের পরে শুধু লিখতে থাকাটাই একাগ্রতা, এবং অবশ্যই তিনটি ধাপের যে কোনো একটিকেও পরিহার করার সুযোগ থাকে না কবির, যে বা যারা কোনও একটি ধাপকে ওভারলুক করে এগোবে সস্তা জনপ্রিয়তাই তাদের কবিসত্ত্বাটিকে গ্রাস করে ফরমায়েশি বা গড়পড়তা অবস্থানে নামিয়ে আনবে। এইটা নিউটনীয় ২য় সূত্রের মতো স্পষ্ট, কবিকে সেই ব্যক্তিত্ব গড়ে তুলতে হয় যার সামনে এভারেজ বা এরও নিচকার কবিতাশক্তির পৃষ্ঠপোষক মিডিয়াকে অসহায় দেখায়, ব়্যাঁবোর এই গল্পটি স্পর্ধার, এই স্পর্ধা একটা আরাধনা, এই আরাধনাকে সহস্র ক্যালোরির উপেক্ষাও সমঝে চলে, আর সমকাল সত্যিকার অর্থে মূল্যায়নের কেউ নয়, কবিকে এইদিক থেকে নির্লিপ্ত হতে হয় বোধ করি, মিডিয়া কবিতার খুব একটা কাজে আসে না, বড়জোর কবিকে ঠেলেঠুলে প্রতিষ্ঠা এনে দেয়, আর কে না জানে কবিকে মেরে ফেলে প্রতিষ্ঠার তৃপ্তি!
বিন্দু bindumag.com
বাংলা কবিতাতেও একই কথা খাটে। বুদ্ধদেব বসু, আবু সায়ীদ আইয়ুব, সিকান্দার আবু জাফর, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, আহসান হাবীব প্রমুখ সম্পাদক হিসেবে এই বিষয়টিকেই প্রাধান্য দিয়ে গেছেন আমৃত্যু, আর কবি তো ভাষার ঋষি, ভাষার দুর্ধর্ষতম মাস্তান, নির্মাণে ট্রেণ্ডসেটার হবার বিকল্প অন্য কিছুতেই নেই কবির জন্য।
র্যাবোর কথা উঠলেই আরো আরো কানেক্ট হইতে মন চায়। কবি হইলো ভাষার মাফিয়া এজেন্ড। ভাষারে ভাঙায়া নতুন নকশা বানানোর মাস্তান।
উত্তরমুছুনসমুচিত বক্তব্য, ভালোবাসা জানবেন
মুছুন