লিখেছেন: মাহফুজুর রহমান লিংকন
বিন্দু মানেই আমার আবেগ। বিন্দু মানেই আমাকে পুনর্জীবিত করার মন্ত্র। কারণ যদি বলতে যাই, অনেক কাহিনী, অনেক অপ্রিয় সত্যকে বলতে হবে তাই কারণ না জেনে শুধু এতটুকু জানতে পারেন- আমি লিংকন, লিংক অন (কবি রাশেদুন্নবী সবুজ এর ভাষায়) হয়ে উঠেছি শুধু বিন্দু পরিবারের একজন হতে পেরে।
১৯৯২ সাল থেকেই কবিতা লেখার কাজটা খুব গভীরভাবে আমি উপলব্ধি করি, সেই থেকে শুরু। '৯৫ পরবর্তী সালের দিকে আমি শুধু লিখেছি... কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজে নতুন অনার্স কোর্স চালু হয়েছে, বাংলা বিভাগ, ইংরেজি বিভাগ চালু হয়েছে। সেই ছাত্রদের কেউ কেউ লিখে। কিন্তু কোনও সাহিত্য চর্চার বা নিজেকে প্রকাশের মাধ্যম নেই; তখন আমি নিজ উদ্যোগে দেয়াল পত্রিকার ব্যবস্থা করি (প্রয়াত ইংরেজির অধ্যাপক তপন কুমার রুদ্র স্যারের সহযোগিতায়)। সে সময়, কুড়িগ্রাম জেলার অনেক রথি–মহারথির সংস্পর্শে আসার সৌভাগ্য/দুর্ভাগ্য হয়েছিল। সৌভাগ্য এই অর্থে যে, এদের সংস্পর্শে এসেই বুঝতে পেরেছিলাম, এ যুদ্ধ একান্তই আমার নিজের। দুর্ভাগ্য! একারনে বলছি যে, এদের কাছে গিয়ে নিজের প্রতি অনেকটা অবিচার করে ফেলেছিলাম। কারণ, এরা নিজ আত্মকেন্দ্রিকতা আর পরচর্চা-পরনিন্দা ছাড়া কিছুই বোঝে না, বুঝতে চায়ও না! মজার বিষয়, ঐ সব রথি–মহারথিগন আজও তাদের কূয়োর ভিতরেই রয়ে গ্যাছেন...
মাঝখানে অনেকটা সময়, বলা চলে সুদীর্ঘ সময় ধরে নিজেকে নিমগ্ন রেখেছি কবিতার ধ্যানে, কিন্তু কবিতা কি হচ্ছে? না কি কি হচ্ছে না, সে ভাবনা কখনোই আমাকে তাড়িত করেনি। বার বার শুধু মনে হয়েছে লিখছি তো, চলুক না! আমি তো কবি হতে চাই নি, চেয়েছি কবিতা যাপন করতে। করেও যাচ্ছিলাম... হঠাৎ...
২০১২ সালের মাঝামাঝি সময় বিন্দু’র মূল কাণ্ডারি অনুজ কবি সাম্য রাইয়ানের সাথে পরিচয় তুলশি দাদার দোকানে। সাম্য’র সর্ম্পকে আগেই সামান্য কিছু জেনেছি বটে, (এখানে বলে রাখি, সে সবই নেগেটিভ কথা। একজন মানুষ সম্পর্কে যত ধরনের বাজে কথা বলা যায়, প্রায় স-ব) কিন্তু পরিচয়ের পর ধ্যান ধারনা বদলে গেল। এরপর ইতিহাস...
একদিন সন্ধায় সাম্য এসে বলল- ভাই, আমরা প্রতিদিন এক পাতার একটা কবিতার পত্রিকা বের করছি, আপনার একটা লেখা দেন। আমি অনেক পুরনো একটা পত্রিকা (আমার সম্পাদনায়) ওঁকে দিয়ে বললাম, এখান থেকে যেটা ভালো লাগে নিয়ে নে। সেই থেকে শুরু...
জীবিকার প্রয়োজনে ঢাকাতে চলে আসি, কিন্তু সাম্য আর বিন্দু আমার পথ চলার পাথেয় হয়ে রইল। বিন্দু’র সাথে মিশে গেলাম, বিন্দু বরাবর সকলের সহযোগিতায়, সকলের অর্থায়নে প্রকাশ হয়, এটা সকলের জানা। মজার বিষয় হল, বিন্দুতে তখনো আমার একটি লেখাও প্রকাশ হয় নি, আমি দুই হাতে লিখে যাচ্ছি, সাম্য’র সাথে লেখা নিয়ে আলোচনা করে যাচ্ছি। কিন্তু সাম্যকে কখনোই বলার সাহস পাচ্ছি না যে “সাম্য, আমার লেখা কি দেয়া যাবে বিন্দুতে?”
যারা বিন্দু সম্পর্কে বলেন, বিন্দুতে শুধু তাদের লেখাই ছাপা হয়, যাদের সঙ্গে সাম্য, সবুজের সম্পর্ক ভালো। তাদের উদ্দ্যেশে অতি বিনয়ের সাথে বেয়াদবের মতো বলতে চাই, ভাইজানেরা! আমার লিংকনের লেখাও ছাপা হয় নাই বিন্দুতে ততক্ষন, যতক্ষণ না বিন্দুর সম্পাদনা পরিষদ (সম্পাদনা পরিষদ না বলে বলা যায় বিন্দু পরিবার) মনে করেছে, ‘এগুলো কবিতা’।
এবার আসি শিল্পের বিচারে বিন্দু’র অবস্থান। শিল্পদর্শনে যে কয়েকজন মহামানবের কথা আমরা চিন্তায় ও সুউচ্চ ব্যঞ্জনায় বলতে পারি তাদের মধ্যে রঁমা রঁলা অন্যতম স্মরণীয় । তিনি বলেছেন- If art has to dabble with falsity, I say good bye to all art.
অর্থাৎ শিল্প যদি মিথ্যার বেসাতি করে তবে সেই শিল্প তাঁর কাছে পরিত্যাজ্য।
বাজারি চিন্তা চেতনাকে কাজে লাগিয়ে নানা রকম প্রচারণা চালিয়ে, বিজ্ঞাপনের চাতুরীরঙ্গে মিথ্যার বেসাতি করে বাংলা ভাষায় অনেক লিটলম্যাগ চলছে, এসব লিটলম্যাগ’র না আছে প্রতিবাদের ভাষা, না আছে শিল্পবোধ!
বিন্দু এখানেই ব্যতিক্রম, বিন্দু অন্যায়ের প্রতিবাদ করে (যার জ্বলন্ত প্রমাণ ২০১৮’র বইমেলা), বিজ্ঞাপনের চাতুরী মিশিয়ে মিথ্যার বেসাতি করে না, বিন্দু পরিবারের মানুষগুলোকে যারা চরমভাবে পরিতাজ্য ভাবে তারাও লুকিয়ে বিন্দু পড়ে, অপেক্ষা করে বিন্দুর নতুন সংখ্যার, যার ফলে অসংখ্য পাঠকের ভালোবাসায় বিন্দু এক যুগ ধরে বাংলা শিল্প সাহিত্যের ভূমিতে তাঁর চাষাবাদ করে চলেছে…
টলস্টয় তাঁর “What is Art” বইয়ে বলেছেন- Art is human activity consisting in this, that one man consciously by means of creating external signs, hands on to others felling he has lives through, and others are infeeted by these felling and also experience them.
অর্থাৎ তাঁর মতে, শিল্প একটি মানবিক কাজ, একজন মানুষ থেকে আর একজন মানুষের হৃদয়ে ভাবানুভুতি ও সুখানুভূতি, দুঃখানুভুতি সঞ্চারিত করে দেয়াই শিল্পের কাজ।
তাহলে সমস্ত মানবিক ক্রিয়াই কি যথার্থ শিল্প? এ কারনেই তিনি এই অধ্যায়ে পরক্ষনেই বলেছেন- …by art, in the limited some of the word. We do not mean all human activity transmitting feeling but only that part which we, for some reason, select from it and to which attach special importance.
খুব সাদামাটা ভাষায় আমরা বলতে পারি, টলস্টয়ের মতানুসারে, শিল্পীকে তাঁর শিল্পের মাধ্যমে অনুভুতির সঞ্চালন করে দিতে হয়, তাহলেই শিল্পের পুর্ণতা পায়।
তাহলে এটাও বলা যায়, শিল্প হবে সহজ, স্পষ্ট ও জলের মত তরল এবং সকলের বোধগম্য, যেন অতিসাধারনের মাঝেও তা সঞ্চালিত হতে পারে।
বিন্দু বরাবর সেই চেষ্টাই করছে…
অতি দুর্বোধ্যকে বিন্দু যেমন এড়িয়ে চলেছে, তেমনি অতিদুর্মুখোকেও এড়িয়ে চলেছে…বিন্দু চেয়েছে একেবারে অতিসাধারনের কাছে পৌঁছতে।
অবনীন্দ্রনাথ শিল্পের বিষয়ে বলেছিলেনঃ Art is not a pleasure trip, it is a battle (Millet)
শিল্পের সৃষ্টি শুধুমাত্র নিছক আনন্দ দানের বিষয় নয়, বলা হচ্ছে এটি একটি যুদ্ধ! সহজভাবে বলতে গেলে বলা যায়, শিল্পী তাঁর সমস্ত শক্তি দিয়ে তাঁর শিল্প মাধ্যমে সমস্ত অসত্যকে, অসুন্দরকে, অমঙ্গলকে দূর করে দিবে, তবেই তাঁর শিল্পের সার্থকতা। শিল্পের যুদ্ধ অসত্যের বিরুদ্ধে, অসুন্দরের বিপরীতে।
বিন্দু জন্মলগ্ন থেকেই এ যুদ্ধ করে আসছে। যখন সারা বাংলায় প্রগতিশীল লেখক, প্রকাশকদের মৌলবাদী শক্তির রোষানলে পড়তে হয়েছে, মৃত্যুর মিছিলে যখন নাম বাড়ছে প্রগতিশীল লেখক, প্রকাশকদের তখনো বিন্দু পিছপা হয়নি, সে সময়কার বিন্দুর দিকে লক্ষ করলেই বোঝা যাবে- বিন্দুর প্রতিবাদ!
নিছক কৌতুহলবশতঃ কিংবা নাম কামানোর আশায় অথবা প্রতিহিংসা পরায়ণ হয়ে বিন্দুর জন্ম হয়নি, বিন্দুর জন্ম প্রয়োজনের তাগিদেই। কেননা বিন্দু পরিবার সর্বদাই ভেবে এসেছে, সুন্দরের মুক্তি কীভাবে সম্ভব। কিভাবে সৃষ্টিশীল মানুষগুলোকে ভালোবাসা দিয়ে এক সুতোয় বেঁধে রাখা যায়। যা কিছু অসুন্দরের জন্ম দেয়, বিন্দু কোনদিনও সে পথে চলার ভাবনা নিয়ে এগোয় নাই। একারনেই বিন্দু যেমন রাজনৈতিক ফায়দা লুটেরাকারীদের প্রতিহিংসার শিকার হয়েছে, তেমনি হয়েছে অনেকের বুকের ব্যথার কারণ। সাথে আছে হাজারো পাঠকের ভালোবাসা, মুগ্ধতা আর বিন্দু পরিবারের দায়বদ্ধতা, হেতু এক যুগ ধরেই বিন্দুর যুদ্ধ চলছে, চলবে... শিল্পের মুক্তি, সুন্দরের মুক্তির জন্যই মঙ্গলের পথে বিন্দুর পথ চলা অবিরাম...
লিটলম্যাগ এর ক্ষেত্রে আজকাল যে বিষয়টি প্রায় শূন্যের কোঠায় এসে পৌঁছেছে সেটা হল, যৌথ-সমন্বয়। যেখানেই স্বেচ্ছাচারিতা সেখানেই সৃষ্টিশীলতা বিঘ্নিত হয় বলে আমার মত।
আমি বরাবর আড্ডা পাগল। সাম্যের সঙ্গে পরিচয় হবার পর আমাদের আড্ডা চলত। দিনের বেলা সময় করে উঠতে পারতাম না। সাধারণত সন্ধ্যার দিকে হয় কুড়িগ্রাম কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পিছনে কোন চায়ের দোকানে, জেলা পরিষদ মার্কেটের উপরে, কবর স্থানের সামনে কখনো ঘোষপাড়ার চায়ের দোকানে দশ-বার জন মিলে শুরু হত আড্ডা। কি ছিল না সে আড্ডায় আলোচনায় বিষয়! সন্ধ্যা থেকে শুরু করে মধ্যরাত অব্দি চলত সে আড্ডা (আড্ডার সবশেষ মানুষ আমরা তিন জন- স্বপন ভাই, সাম্য আর আমি!) সে আড্ডাতে বিন্দুর রসদ চলে আসত।
বিন্দু এক যুগ সময়েও সেই ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছে। বিন্দু প্রকাশের আগে এই পরিবারের প্রতিটি সদস্যের কাছে পৌঁছে যায়, বিন্দুর ঐ সংখ্যার কনসেপ্ট, লেখার পাণ্ডুলিপি সহ প্রতিটি বিষয়। দীর্ঘ সময় হয়ত একে অপরের সাথে কথাও হয়নি, না ফোনালাপ, না মুখ দর্শন কিন্তু বিন্দু যেই না প্রকাশ করা হবে বলে কেউ একজন সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল, অমনি শুরু হয়ে গেল বিন্দু পরিবারের সদস্যের মাঝে দীর্ঘ আলোচনা। সম্ভবত এদেশে বিন্দুই একমাত্র পত্রিকা যে তার লেখকদের বলতে পারে, “আপনি চাইলে আপনার সম্পাদনায় বিন্দুর সংখ্যা করতে পারেন”। সকলের মতামত, সুদীর্ঘ আলোচনার ভিত্তিতেই বিন্দুর প্রকাশ ঘটে। ফলে, বিন্দুর সৃষ্টিশীলতা কমে না বরং স্রষ্টা আর সৃষ্টির সমন্বয় ঘটিয়ে বিন্দু করে তোলে পাঠক মুগ্ধ!
বিন্দুর এই পথচলাকে যারা মেনে নিতে পারছেনা তাদের জন্য যেমন বিন্দুর পক্ষ থেকে শুভকামনা তেমনি বিন্দুর এই একযুগ পথচলায় যারা সাহায্য সহযোগিতা করে বিন্দু পরিবারের একজন হয়ে উঠছেন তাদের জন্যও শুভকামনা! পাঠক, আপনাকে সেলাম… মঙ্গল হোক সকলের...
মন্তব্য