স্টলে এই ফেস্টুনটি টাঙানো হয়েছিল। |
ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রের যাবতীয় ইমেজ লইয়াই বিষয়টা স্টার্ট হইছিল। ডিএমপি সদর দফতরে ‘বইমেলার নিরাপত্তা’ ব্যবস্থা লইয়া ডিএমপি কমিশনার বাৎচিতের আয়োজন করছিলেন ২৫ জানুয়ারি। বইমেলার নিরাপত্তা লইয়া আমরা কনসার্নড নই এমন নহে; আমরাও এই ম্যাটারে উদ্বিগ্ন। হুমায়ূন আজাদ থেকে শুরু কইরা অভিজিৎ রায়ে আইসাও এই উদ্বেগে আশ্বস্তের লাগাম পড়াইতে পারি নাই আমরা। কিন্তু, পাঠিকা নোট নিবেন, হুমায়ূন আজাদ কিংবা অভিজিৎ রায় কেহই মেলার ভিতরে কোনও রকম সাবজেক্ট কিংবা অবজেক্ট দ্বারা আক্রান্ত হন নাই; উনারা মেলার বাইরে হামলার শিকার হইছেন। ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রের উচিত আছিল মেলার ভিতরে গবদা-গবদা পুলিশ মোতায়েন না কইরা মেলার বাইরে নিরাপত্তা বেষ্টনী জোরদার করা। বলা বাহুল্য, এতে রাষ্ট্র ব্যর্থতার পরিচয় দিছেন। মেলার বাইরে যে পুলিশি বেষ্টনী কিংবা জল-কামানের ব্যবস্থা রাখা হয় নাই এমন না; রাখা হইছে। কিন্তু, অই নিরাপত্তা বলয়ের মধ্যেই অভিজিৎ রায় হামলার শিকার হইছিলেন।
এই নিবন্ধের লেখক সশরীরে মেলায় গিয়া দেখছেন নিরাপত্তার বহর। সিসিটিভি, ওয়াচ টাওয়ার, পুলিশি বেষ্টনী, আর্চওয়ে, মেটাল ডিটেক্টর, টুরিস্ট পুলিশ সাথে মেলার বাইরের রাস্তার যানবাহন চলাচল সীমাবদ্ধ করা, পুলিশের ব্যারিকেড, ডিবি পুলিশের আনাগোনা ইত্যাদি। মেলার ‘নিরাপত্তা ব্যবস্থা’ লইয়া উপরে বলা পর্যবেক্ষণ পর্যন্ত-ই আমার বিবৃতি।
কিন্তু, মেলার নিরাপত্তার লগে লগে ডিএমপি কমিশনারের মেলায় আসা নয়া বইয়ের ‘রাষ্ট্রীয় বিশুদ্ধতা’ রক্ষার ফিকিরও হইছিল। তিনি তার বক্তব্যরে আরেকটু আগাইয়া বলেন, ‘এছাড়া নিরাপত্তার স্বার্থে মেলায় আসা যে কোনও নতুন বই বাংলা একাডেমি যাচাই-বাছাই করে দেখে স্টলে বিক্রির অনুমতি দেবে।’ ফ্যাঁকড়াটা এই যায়গাতেই বাঁধছে আরকি! কারণ হিশাবে বলা হয়, ‘যাতে কোনও বই ধর্মীয়, সামাজিক ও জাতীয় মূল্যবোধে আঘাত না করতে পারে।’
ডিএমপি কমিশনারের আগের নিরাপত্তা ব্যবস্থা লইয়া আমাদের কিঞ্চিত মাথা নাড়ানো থাকলেও বইয়ের শুদ্ধতার ‘মেলার নিরাপত্তা স্বার্থ’ লইয়া আমরা ক্ষুব্ধ, হতাশ এবং চিন্তিত। রাষ্ট্র তার পূর্ণ টোটালিটারিয়ান আচরণ আমাদের সামনে শো-অফ করার তরীকা বাতাইতেছে!
প্রথমত বাংলা একাডেমি কোনও ‘লিটমাস পেপার’ নহে যে বইয়ের শুদ্ধতা যাচাই করবেন। প্রসঙ্গত, বাংলা একাডেমি নিজে একটা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান এবং এই প্রতিষ্ঠান নিজেই নানাবিধ কর্মকাণ্ডে প্রশ্নবিদ্ধ হইয়া আছে। একাডেমি’র পুরস্কার, একাডেমি’র ভাষারীতি, লিটারেচারকেন্দ্রীক নানান ফেস্ট ইত্যাদি বিষয়ে নানান ধান্ধাবাজি পূর্বেই বাংলা একাডেমির ক্লিন অবস্থানরে বিদ্রুপ করে। সুতরাং প্রথমত, বাংলা একাডেমির বই যাচাই-বাছাই করার প্রাধান্য অই অর্থে ক্রিয়েটিভ রাইটারদের কাছে প্রায়োরিটি পায় না এবং রেসপেক্টও পায় না। দ্বিতীয়ত, বাংলা একাডেমি’র দ্বারা কোনও নির্দিষ্ট মান নির্ধারণ কইরা দেওয়া নাই যে, এইটা হইলে বইয়ের বিশুদ্ধতা রক্ষা হয় অথবা এইটা করলে বিশুদ্ধতা রক্ষা হয় না; ডিএমপি কমিশনার কইছেন তিনটা শব্দঃ ১) ধর্মীয় ২) সামাজিক ৩) জাতীয় মূল্যবোধে আঘাত।
এই তিনটা কন্টেন্ট যখন মাস পিপলের যে-কোনও মূল্যবোধে আঘাত করবে তখনই বই বাতিল হইয়া যাবে; এমনকি মাস পিপলের মূর্খ এবং ইরেশনাল মূল্যবোধগুলারে আঘাত করলেও! নিতান্তই অবিবেচকের মতো আলাপ ঠাউরাইতেছেন ডিএমপি কমিশনার। আমাদের স্থুল-বেকুব জাতীয় মূল্যবোধ লইয়া আলাপ করা, খোঁড়া সোশ্যাল অবস্থা লইয়া আলাপ করা এই ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র ‘বইয়ের বিশুদ্ধতা’ রক্ষার কথা বইলা বন্ধ কইরা দিতে চায়।
স্টলের সামনে দাঁড়িয়ে ফেস্টুন পড়ছেন কোন এক বইপ্রেমী |
এই কথার প্রতিবাদস্বরূপ লিটল ম্যাগাজিন ‘বিন্দু’ মেলার পয়লা দিন স্ট্রাইক করে। ‘বিন্দু’র লিটলম্যাগ টিম হইতে সিদ্ধান্ত আসে মেলার ১ তারিখ হইতে ৫ তারিখ পর্যন্ত তাঁরা তাদের স্টল বন্ধ রাখবে। বিন্দু’র সম্পাদক সাম্য রাইয়ান এই ঘোষণা দেন। এবং দুসরা দিন বিন্দু’র পক্ষ হইতে আমি স্টলের উপর ‘প্রতিবাদ প্ল্যাকার্ড’ লাগাইয়া দিয়া আসি। প্ল্যাকার্ড লেখেন এ.এস. তুর্য।
বিন্দুর প্রতিবাদ আছিল ৫ তারিখ পর্যন্ত। ৬ তারিখ বিন্দু’র কার্যক্রম পুনরায় শুরু করার কথা। কিন্তু, ৬ তারিখ মেলায় গিয়া দেখা গেল মেলা’র অথরিটিগণ বিন্দু’র স্টল ভাইঙ্গা দিছে। প্ল্যাকার্ড সরাইয়া নিছে। বিন্দুর স্টলের নামলিপি সরাইয়া ফেলা হইছে।
এখন কথা হইল, ১১ বছরে পয়লা বার বইমেলায় স্টল পাইয়া বিন্দু একটা অন্যায্য বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় যে প্রতিবাদে শামিল হইছিল সেই প্রতিবাদরে দমাইতে বাংলা একাডেমী যে সিচুয়েশন ক্রিয়েট করছে এতে বাংলা একাডেমির স্থুল কর্মকাণ্ডের বোঝা আরেকটু ভারি হইল। সেই সাথে, প্রতিবাদে শামিল না হওয়া লেখক-সাংবাদিক-প্রকাশকদের চেহারাও উন্মোচন হইল। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা যায়, বিন্দু’র ৫ দিনের প্রতিবাদের নিয়ুজ খবরের কাগজ কিংবা অনলাইন নিয়ুজ পোর্টালগুলায় যেন প্রকাশ না করা হয়, এর জন্য উপরি মহল হইতে চাপ দেওয়া হয়।
বইমেলার হিসাব থেকে জানলাম, মোট ১৬১টা লিটল ম্যাগাজিন জায়গা পাইছে মেলায়। এই ১৬১টা লিটল ম্যাগাজিনের একটারও কি হিম্মত হইল না বিন্দু’র পাশে দাঁড়ানোর? বাংলা একাডেমি মেরুদণ্ড হারাইছে বহুকাল গত হইছে; লিটল ম্যাগাজিনগুলা যে মস্তিষ্ক হারাইছে সেটা ক্লিয়ার হইল একাডেমির মুখোমুখি বিন্দু’র অবস্থানে। সুতরাং, এই ক্লিয়ারনেসের দরকার ছিল। দরকার ছিল অন্তত মস্তিষ্ক হারাইয়া ফালানোদের সংখ্যা নির্ণয় করার জন্য হইলেও।
সাবাশ বিন্দু
উত্তরমুছুনবিন্দুর প্রতি ভাললাগা ভালবাসা এতসব কারণেই।
উত্তরমুছুনএই হচ্ছে প্রকৃত লিটলম্যাগ