এই তো পার হয়ে এসেছি
কাঁচবন্দি সারি সারি নিষ্প্রাণ শরীর
ওদের মসৃণ দেহে-মুখে-চোখে
কোথাও কোন ক্ষত চিহ্ন নেই।
আমাকে তোমার নাম বলো। তাহলে তোমার নামটা জানা হবে। কেউ একজন থেকে তুমি যথার্থ একজন হয়ে উঠবে তখন। তোমার নাম ধরে তোমাকে ডাকা যাবে, কথার ফাঁকে ফাঁকে। ধরো, অন্য কাউকে যখন তোমার কথা বলব, তখন তোমার কথাই বলা হবে। নাম ছাড়াও তুমি আছ, জলজ্যান্ত একটা মানুষ, কিন্তু নাম ছাড়া তোমায় ধরতে পারি না। তোমার নামের কথা আমাকে বলো। সব নামের একটা গল্প থাকে। কে রেখেছিল ঐ নাম? মা, বাবা, নাকি অন্য কেউ? কেনই বা ঐ নামটা, কেন অন্য কোন নাম নয়? আমাকে তোমার নামের গল্পটা বলো।
আমাকে তোমার গল্পগুলো বলো। সকলেরই গল্প থাকে। উচ্ছল আনন্দ কিংবা বেদনাবিধুর গল্প। তোমার গল্পগুলোতে তোমাকে আরো ভালো বুঝতে পারি। তোমার গল্পের ভেতর দিয়ে তোমাকে চিনে নিতে পারি। মানুষকে চেনা তো সহজ কিছু নয়। সারাজীবন ধরে দেখে-শুনেও বোঝা যায় না এমন। বদলে যেতে যেতে এমনকি কত মানুষ নিজেকেই চিনতে পারে না ঠিকমতো। কিন্তু তোমাকে ঠিকঠাক চিনে-বুঝে নিতে চাই, চাই যে তুমি নিজেও নিজেকে বুঝে নাও ঠিকঠাক। ভুল বোঝাবুঝির কুয়াশা কেটে না গেলে সূর্যের আলো ছড়াবে কি করে। তারপর পরিষ্কার দেখে নেয়া যাবে জীবন-চরাচর।
আমাকে তোমার গ্রামের কথা বলো, কিংবা বলো তোমার শহরের কথা। যেখানে বেড়ে উঠেছ তুমি আরো অনেকের মতো, অনেকের সাথে। তুমি যতটা একা, আবার তুমি তো ততটা সঙ্গপ্রিয়। সেই অঞ্চলের কথা শুনতে চাই, শুনতে চাই সেখানকার পথের কথা, যে পথের ধুলোয় হেঁটে বেড়িয়েছ তুমি সকাল-দুপুর-বিকাল-সন্ধ্যা অথবা রাত। সেই ধুলোর গন্ধ তোমার চেনা, রাস্তার দু’পাশের ঝোপে কখন কী ফুল-ফোঁটে, জলাশয়ের জলের গভীরতায় সাঁতরে বেড়ায় কোন ছোট মাছ, সব তোমার নিজের শরীরের মতই পরিচিত। সেখানে মাঠজুড়ে সবুজ ঘাসের সঙ্গে তোমার নিবিড় বন্ধুত্ব ছিল। দৃষ্টি জুড়ে ছিল নীল দিগন্ত। সেখানে ভোর থেকে সন্ধ্যার প্রত্যেকটি সময়ের ছিল আলাদা আলাদা ঘ্রাণ।
আমাকে তোমার লুকোনো বেদনার কথাগুলো বলো। বলো আশ্চর্য আনন্দের কথাগুলোও। আজ তুমি যা, তার পেছনের কথা তো কম নয়। আজ যেখানে দাঁড়িয়ে আছ, সেখানে অনেক পথ হেঁটে তবেই না এসেছ তুমি। সেই পথ সর্বদা মসৃন ছিল না। সেই পথে তবু কিছু কিছু বিশ্রাম জুটেছে তোমার, কিছু দুর্লভ ছায়া। যা তুমি আগলে রেখেছ যত্নে। তার সব তোমার, সব সুখ, সব অসুখ। সব প্রত্যাখ্যান, সব আমন্ত্রণ। তোমাকে সঙ্গ দিয়েছে কেউ, আবার কেউ কেউ তো ফিরেও তাকায় নি। তবু তোমার থেমে যাওয়া হয় নি। প্রত্যাশা ছিল যেমন, তেমনই স্বপ্নভঙ্গও ছিল। তোমার তাই একটা ইতিহাস আছে নিজের। তোমার ইতিহাসটা তুমি তোমার জীবন দিয়েই তো লিখেছ, লিখে যাচ্ছ। জানা-অজানা কতো নানা চরিত্রের উপস্থিতি আছে সেই গল্পে। সেই গল্পের সব তোমারও জানা নেই তাই। কখনো জানা হবে না। অন্যদের গল্পগুলোর সঙ্গে জুড়ে দিয়েই না তোমার গল্পের পুরো কাহিনীটা পাওয়া যাবে। চুপ করে থেকো না তাই। তোমার গল্পটা আমাদের বলো। আমাদের নিজস্ব গল্পগুলো পরস্পরকে শুনিয়ে ব্যক্তিগত গল্পগুলোকে সম্পূর্ণ করি এবার।
আমাকে তোমার নাম বলো।
বলো, তোমার পরিবারের কথা,
চেনা গ্রাম, অভ্যস্ত শহর ,
প্রিয় বন্ধুদের ডাকনাম।
তোমার স্বপ্ন-নৈরাশ্য কত
সংগ্রাম-বিদ্রোহ-বাসনা,
আনন্দের উজ্জ্বল অলংকার,
ঢেকে রাখা বেদনার ক্ষত।
তোমার গল্পগুলো শুনতে চাই আমি,
তোমার গল্পে রয়েছি আমিও
জেনো-
আমার ইতিহাসে আছো তুমি।
আমাকে তোমার ইতিহাস বলো-
আমাকে তোমার নাম বলো।
মন্তব্য