সৈয়দ সাখাওয়াৎজন্ম : ৮ আগস্ট ১৯৭৮, চট্টগ্রাম, বাংলাদেশ।চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নৃবিজ্ঞানে স্নাতোকোত্তর।
প্রকাশিত কবিতাবই :খণ্ড খণ্ড রাত্রির আলাপ (২০১৩, কাঠপেন্সিল প্রকাশনী)পাতাচূর্ণ উড়ে যাবার সাথে সাথে (২০১৭, বাঙ্ময়)নিহিলের বনে (২০২১, বাঙ্ময়)
প্রশ্ন: আপনার জীবনে লেখালিখির শুরু কীভাবে? আর সিরিয়াসলি লিখতে শুরু করলেন কবে থেকে? কীভাবে?
উত্তর: স্কুলে দেয়াল পত্রিকায় ছড়া লিখে শুরু। বাসায় লেখালেখির অভ্যাস সবারই ছিল, আছে। আমার অপর দুই সহোদরও লেখালেখি করতেন,করেন। বাবার লেখা কবিতার ডায়েরী আর প্রকাশিত কবিতা দেখে সম্ভবত কবিতা লেখার চেষ্টা। প্রাতিষ্ঠানিক লেখক পরিচয়ে কেউই নেই। সে যাই হোক। শিক্ষা জীবনের মাঝামাঝিতে রাজনৈতিক সংবেদনশীলতার জায়গা থেকে সিরিয়াসলি ( প্রশ্নসাপেক্ষ) লেখালেখি শুরু করি। সময়টা ৯৭-৯৮ সালের কথা।
প্রশ্ন: কবিতাকে অনেকেই অনেকভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। আপনার কাছে কবিতার সংজ্ঞা কী?
উত্তর: এককথায় কবিতা কী বলার চেষ্টা আমি করি না। আমার কাছে কবিতা অনেক বেশি উপলব্ধি, অনুভব আর দেখার বিষয়। এখানে একেকজন একেকভাবে দেখেন। কবি’র তো মুক্তি নাই, এই যে এতো এতো ঘটনা, দৃশ্য, রূপ; আবার এক দৃশ্য থেকে আরেক দৃশ্যে রূপান্তর; সবকিছুই কবির দৃষ্টিগোচর হয়। কবি, কবিতায় দেখেন ভেতরের টানা-পোড়েন। পৃথিবীতে এমন লোক খুব কমই পাওয়া যাবে, যে জীবনে একটিও কবিতা লেখেনি। আর বাঙালির কথা যদি বলা হয়, তবে তা অবশ্যম্ভাবী। সেই অর্থে সকলেই জীবনের একটা মুহুর্তের জন্য হলেও কবি। কবি: মানে যিনি কবিতা লিখে যান।তার মানে এটা প্রতিনিয়ত সম্পৃক্ততার বিষয়, বিষয়ের সাথে, বিষয়ের বাইরে; কোনো এক নিজস্ব নির্মিত জগতে; যেখানে সর্বক্ষণ আসা যাওয়া করে শব্দময় রূপকল্প। তারমানে এটা চর্চার। কেউ একজন কথার ফাঁকে বলেছিল, লিখতে লিখতে একসময় লেখার ভাষা আলাদা হয়ে যায়, নিজস্বতা তৈরী হয়, ওটাই কাউকে স্থায়ীভাবে উপস্থাপন করে- “এটা অমুক”। তারমানে কবি এখানে একাই, এ’জগৎ তার নিজস্ব, প্রতিনিয়িত ভেঙেচুরে বের হয়ে আসা। কবিতা যে কী, এ’নিয়ে বহু কথা বলেছে প্রায় সকলেই। বিশেষত, যারা লিখেছেন, লিখে চলছেন। এমনকি যারা লিখেন না, তারাও। নানা মন্তব্য, ভাব, এমনকি কটূ বাক্যও। তা সে যাই হোক, এতে কবির কোনো যায় আসে না। কেননা , কবি যে জগতে ছুটে বেড়ান, সে জগতে সে নিজেই রাজা, বাদশাহ্-নামদার। এতে কারো কারো অহঙ্কারও প্রবল! আর কাউকে যে তিনি মানতেই চান না কবি বলে! তিনি একাই শাসন করতে চান এ’সা¤্রাজ্য! এও কী আরেক দ্ব›দ্ব নয়? তারপরও কবি আর কবিতা পাশাপাশি হেঁটে যায়, মুক্তি নাই। তাই আনুষ্ঠানিক সংজ্ঞার চেয়ে বরং উপলব্ধির বিষয়টিই আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ।
প্রশ্ন: কেউ কেউ- যেমন এলিয়ট, এজরা পাউন্ড, হুইটম্যান প্রমুখ কবি কবিতাকে শ্রমসাধ্য বিষয় বলে মনে করেন; অন্যদিকে ওয়ার্ডসওয়ার্থ, কোলরিজ, ইয়েট্স প্রমুখ কবি কবিতাকে স্বতঃস্ফুর্ত প্রকাশ বলে মনে করেন- এ-ব্যাপারে আপনার অভিমত কী?
উত্তর: আমি নিজেও ওয়ার্ডসওয়ার্থ, কোলরিজ, ইয়েট্স-এর মতোই মনে করি। কবিতা হাতুরি, বাটালি দিয়ে তৈরী হয় না। করা যায় না। ফলে চিন্তার সৃজনই মূল বিষয়। আগের প্রশ্নের উত্তরেও তাই বলেছি।
প্রশ্ন: লেখার ক্ষেত্রে অথবা ব্যক্তিজীবনে কাউকে অনুসরণ করেন?
উত্তর: সেই অর্থে না। তবে যেকোন লেখায় পূর্বতন পাঠের প্রভাব থাকতে পারে। একসময় জীবনানন্দের প্রভাব ছিল। পরবর্তীতে ল্যাটিন আমেরিকান কবিতার প্রভাবও ছিল। এখন আর নেই। কবিতায় জীবন ঘনিষ্ঠতাকেই বেশি প্রাধান্য দিতে চাই।
প্রশ্ন: এতোদিন ধরে লিখছেন, অথচ প্রকাশিত বই মাত্র একটি। যতোদূর জানি নতুন কোনো বইয়ের কথাও ভাবছেন না। বই প্রকাশের ক্ষেত্রে এই অনীহার কারণ কী?
উত্তর: সঠিক জানা নয়। প্রথম বইটি প্রকাশ হয়েছে আমার সমসাময়িকদের ১০ বছর পরে। ২০১৩ সালে। তাও প্রকাশ হতো কি না আমি সন্দিহান যদি না বন্ধু, প্রকাশক, লেখক বাকি বিল্লাহ দায়িত্ব না নিতেন। তিনি, তার প্রকাশনা সংস্থা “কাঠপেন্সিল” থেকে স্ব-উদ্যোগে প্রকাশ করেছেন বলেই আমার কবিতা দু’মলাটে বাঁধা পড়েছে। আর গত দু’বছর যাবত একটা পাণ্ডুলিপি তৈরী করা আছে, প্রকাশের নিমিত্তে কেউ নেই বলে অপ্রকাশিত। কোনো অনীহা নয়। প্রকাশকের অভাব-ই এখানে বড় কারণ।
প্রশ্ন: আপনার প্রিয় লেখক কারা?
উত্তর: দীর্ঘ তালিকা- জীবনানন্দ দাশ, পাবলো নেরুদা, নিকোলাস গ্যিয়েন, শক্তি চট্রোপধ্যায়, সুভাষ মুখোপধ্যায়, শঙ্খ ঘোষ, আবুল হাসান, সিকদার আমিনুল হক, হাসান আজিজুল হক, সেলিনা হোসেন, আলবেয়ার ক্যামু, কাফকা, এরিক মারিয়া রেমার্ক, হেনরী রাইডার, জুল ভার্ন, মার্ক টোয়েন, মার্কেজ, রাহুল সাংকৃত্যায়ন -আরো অনেকেই।
প্রশ্ন: আপনার সমসাময়িক কোন কোন কবিকে সফল অথবা সম্ভাবনাময় মনে করেন?
উত্তর: এই ভাবনার সাথে আমি কখনোই হাঁটিনি। আমি এটা বিশ্বাসও করি না। আমি মনে করি সফলতা একটা আপেক্ষিক বিষয়। আর সম্ভাবনার ক্ষেত্রে সকলই সমান সম্ভাবনাময়।
কারো কারো ক্ষেত্রে নিয়মিত দৈনিকে লেখা ছাপা হওয়া সফলতার মাপকাঠি, আর কারো জীবনে হয়তো একটা লেখাও কোথাও ছাপা হলো না। কারো ক্ষেত্রে সভা-সমিতিতে কবিতাপাঠ, উত্তরীয় ধারণ, সভাপতিত্ব, জন্মদিবস পালন কিংবা প্রভাব-প্রতিপত্তিই বিরাট সাফল্য। আর কেউ হয়তো জীবনে এর কোনোটিতেই থাকবে না। সম্ভাবনা ও সফলতা সকলের জন্যই তাই সমান। যে যেভাবে দেখে।
প্রশ্ন: রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ দাশ, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত সহ প্রমুখ লেখকের মধ্যেই প্রবল মৃত্যুভাবনা ছিলো। জীবনানন্দ পড়লে তো মনে হয়, তিনি যেন মৃত্যুর মধ্যেই বেঁচে ছিলেন। আপনার ক্ষেত্রে বিষয়টি কেমন? ...মৃত্যুভাবনা?
উত্তর: মৃত্যু এতই অবশ্যম্ভাবী যে, কবিতায় এর রোমান্টিক উপস্থিতি থাকাটাই স্বাভাবিক। আমার কবিতায়ও পাওয়া যাবে তা। তবে আমি প্রবল জীবনের স্বপ্ন দেখি। মিস্টিসিজমও আমার কবিতাভাবনায় কাজ করে। আবার অতি বাস্তব বিষয়ও সরাসরি উপস্থাপিত হয়েছে। ফলে একক কোনো ভাবনা বা তাড়না নেই।
প্রশ্ন: আপনার কবিতা সম্বন্ধে আপনার মন্তব্য কী? কী প্রত্যাশা করেন কবিতা থেকে?
উত্তর: আামার কবিতা সম্বন্ধে যাঁরা পাঠক তারাই প্রকৃত মন্তব্য করতে পারবেন। তবে আমার একান্ত যে অনুভব, তা হলো-এই স্বল্প জীবনের বাইরে-আমি কিছুই লিখিনি। আমার অভিজ্ঞতা আর দেখা- দুই-এ মিলে আমার লেখা।
আর প্রত্যাশার কথা বললে বলবো-কবিতার তীব্র উত্থান হোক মানুষের জন্য। প্রকৃতপ্রস্তাবে মানুষ-ই শেষ কথা। কবিতায় সেই মানবিক মূল্যবোধের প্রকাশ ঘটুক; গোষ্ঠী, ব্যক্তি আর সুবিধাবাদের বাইরে সৃজন হোক।
(এই সাক্ষাৎকারটি প্রথম প্রকাশিত হয় ২০১৫-এ বিন্দুর প্রিন্ট সংখ্যায়।)
দারুণ
উত্তরমুছুনসাক্ষাৎকার ভাল লাগলো৷ কবিতার জয় হোক৷
উত্তরমুছুন